স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৬৩ খ্রীষ্টাদ্বের ১২ জানুয়ারি কোলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর পিতা বিশ্বনাথ দও ছিলেন একজন নামকরা উকিল।তিনি একজন পন্ডিত ও ছিলেন।অনেক ভাষা জানতেন।বিবেকানন্দের ভুবনেঈশ্বরী একজন সুগৃহিণী।
বিবেকানন্দের প্রকৃত নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দও ছেলেবেলায় তাঁর আরেকটি নাম ছিল – বীরেশ্বর।তবে আদর করে তাঁকে সবাই ‘বিলে‘ বলে ডাকতেন।
বিবেকানন্দের জীবন খুব দীঘ ছিল না।মাএ ৩৯ বছর ৫ মাস ২৩ দিন তিনি বেঁচেছিলেন।এই অল্প সময়ে ভারতবষ তথা সমগ্র বিশ্বের মানব জাতির কল্যাণের জন্য তিনি যে অবদান রেখে গেছেন, তা অসাধারণ।চিরদিন মানুষ তাঁর এই অবদানের কথা স্মরণ করবে।
আগেই বলা হয়েছে, ছেলেবেলায় বিবেকানন্দের সবাই বিলে বলে ডাকতেন।বিলে ছিলেন খুবই দুরন্ত ও একরেখা।তবে খুব মেধাবী।লেখাপ খুব ভালো ফল করতেন।পাশাপাশি খেলাধুলা ও গানবাজনায়ও পারদর্শী ছিলেন।বিলেন মধ্যে ছেলেবেলায়ই আরো অনেক গুনের প্রকাশ ঘটেছিল।তিনি যেমন ছিলেন সত্যবাদী, তেমনি ছিলেন নির্ভীক।একটি ঘটনা থেকে জানা যায়।একদিন শ্রেনিতে শিক্ষক পড়াচ্ছেন।বিলে তখন কয়েকজন সহপাঠির সঙ্গে তথা বলছিলেন।তা দেখে শিক্ষক রেগে যান।তিনি তাঁদের পড়া জিজ্ঞেস করেন।বিলে ছাড়া আর পড়া বলতে পারেরনি।কারণ বিলে পড়াও শুনছিলেন আর কথাও বলছিলেন।তাই শিক্ষক বিলে বাদে অন্যদের দাঁড়াতে বললেন।তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে বিলেও উঠে দাঁড়ালেন।শিক্ষক বললেন, তোমাকে দাঁড়াতে হবে না।উওরে বিলে বলেন, আমিও তো কথা বলেছি।অপরাধ তো আমিও করেছি।বিলের এ সততা ও নির্ভীকতা তাঁর পরবতী জীবনেও আমরা দেখতে পাই।
বিলে সাধু – সন্ন্যাসীদের খুব শ্রদ্ধা করতেন।দরিদ্রদের খুব ভালবাসতেন।তাই তাদের দেখলে দৌড়ে যেতেন।ঘরে জামা – কাপড় , খাবার – দাবার যা পেতেন, এনে দিয়ে দিতেন।
বিলে পরবর্তী জীবনে বীর সন্ন্যাসী হবেন, স্বামী বিবেকান্দ হবেন, তাঁর আভাস তাঁর ছেলেবেলায়ই পাওয়া গেছে। বিলে ছিলেন তাঁর খেলার সাথীদের দলনেতা।সুযোগ পেলেই তিনি সাথীদের নিয়ে ধ্যান – ধ্যান খেলায় মেতে উঠতেন।কখনো একা – একাই ধ্যানমগ্ন হয়ে যেতেন।ধ্যান করাটা তাঁর প্রিয় খেলা ছিল।
বিলে বড় হয়েছেন।স্কুল-কলেজের পরীক্ষায় ভালো ফল করেছেন।এখন তাঁকে সবাই আসল নামেই ডাকে।নরেন্দ্রনাথ।নরেন্দ্রনাথ বিএ-ও পাশ করেছেন।আইন ও দশন বিষয়ে তাঁর অগাধ জ্ঞান।এ বিষয়ে তাঁর মনে এক পরিবতন দেখা দেয়।তিনি কেবল ঈশ্বর সম্পর্কে চিন্তা করেন।
তাঁকে কি দেখা যায়?
এ ধররের প্রশ্ন অহরহই তাঁকে মনে জাগে।তিনি অনেককে এ প্রশ্ন জিজ্ঞেসও করেছেন।কিন্তু সদু্ওর মেলেনি।এমন সময় একদিন তাঁর দেখা হয় সাধক শ্রীরামকৃষ্ণকে সঙ্গে।রামকৃষ্ণ তখন দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে আছেন।নরেন্দ্রনাথ একদিন চলে যান সেখানে।রামকৃষ্ণকে তিনি জিজ্ঞেস করেন,
আপনি কি ঈশ্বর দেখেছেন?
রামকৃষ্ণ হাসতে হাসতে বলেন, হ্যাঁ, দেখেছি, যেমন তোকে দেখছি।চাইলে তোকেও দেখাতে পারি।
এই সাদাসিধে সাধক শ্রীরামকৃষ্ণকে নরেন্দ্রনাথের ভালো লাগে।তাঁর প্রতি কেমন যেন একটা ভক্তির ভাব জেগে উঠে।তাই তিনি নিয়মিত দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত শুরু করেন।এক সময় শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট ত্যাগের মন্তে দীক্ষা নেন।নরেন্দ্রনাথ হন গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী।তখন তাঁর নাম হয় বিবেকানন্দ।পরবতীকালে ভক্তরা তাঁকে স্বামী বিবেকানন্দ বা বিবেকানন্দ বলেই ডাকতেন।
বিবেকানন্দ গৃহত্যাগ করেছেন বটে, কিন্তু ভারতবষ এবং তাঁর মানুষকে ত্যাগ করেননি।তাই তিনি বেরিয়ে পড়লেন দেশের পথে পথে।নিজের চোখে দেখতে চাইলেন ভারতবর্ষের মানুষের অবস্থা।তিনি ভারতবষ ঘুরলেন।দেখলেন, সারাদেশে কেবল দারিদ্র্য আর দারিদ্র্য।কেবল অশিক্ষিত আর কুশিক্ষা।দেশবাসীর এই হীন অবস্থা দেখে তিনি খুব কষ্ট পেলেন।তিনি এই অশিক্ষিত, কুশিক্ষা আর দারিদ্র্যের কারণ জানতে চাইলেন।কীভাবে এই থেকে দেশবাসীকে উদ্ধার করা যায়, সে- কথাও চিন্তা করতে লাগলেন।
দেশের তখন ইংরেজ শাসন চলছে।পরাধীন দেশ।তিনি বুঝতে পারলেন, পরের শাসকের দেশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।এ দেশকে বাঁচাতে হবে, জাগাতে হবে।দেশকে স্বাধীনতা করতে হবে।পরাধীন দেশ কখনো উন্নতি লাভ করতে পারে না।দেশের দারিদ্র্য দূর করতে হবে।অশিক্ষিত-কুশিক্ষা দূর করতে হবে।সব মানুষকে ভালোবাসতে হবে।সবার মধ্যে আত্নাবিশ্বাস তুলতে হবে।তবেই দেশের উন্নতি হবে।
১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে বিবেকানন্দ আমেরিকান যান।সেখানে শিকাগো শহরে অনুষ্ঠিত বিশ্বধম সম্মেরনে তিনি বক্তৃতা দেন।বক্তৃতার শুরুতে তিনি উপস্থিত সকলকে ভগিনী ও ভ্রাতৃবৃন্দ বলে সম্বোধন করেন।অন্যরা করেছেন প্রথাগভাবে ভদ্র মহিলা ও মহোদয়গণ বলে।কিন্তু বিবেকানন্দের মুখে এই নতুন সম্মোধন শুনে উপস্থিত সকলে মুগ্ধ হন।অজানা অচেনা লোকদের এভাবে ভাই-বোন বলে আপন করে নেয়ার মানসিকতা দেখে তাঁরা বিস্মিত হন।তাঁরপর বিবেকানন্দ তাঁর বক্তৃতায় বলেন, হিন্দুধম পৃথিবীর সকল ধমকে সমান সত্য মনে করে।সব ধমের লক্ষ্যই এক।নদীসমূহ যেমন এক সাগরে গিয়ে মিলিত হয়, তেমনি সকল ধমের লক্ষ্যই এক-ঈশ্বরলাভ।তাই বিবাদ নয়, পরস্পরের ভাব গ্রহণ;মতবিরোধ নয়, সমন্বয় ও শান্তি।বিবেকানন্দের এই বক্তৃতায় সবাই অত্যন্ত খুশি হন।ধমসভার বিচারে তিনি হন শ্রেষ্ঠ বক্তা।তখন তাঁর বয়স মাএ ৩০ বছর ৮ মাস।
ধমসভায় বক্তৃতার পর সারা আমেরিকায় বিবেকানন্দের নাম ছড়িয়ে পড়ে।বিভিন্ন জায়গা থেকে আহ্বান আসে বক্তৃতার জন্য।তিনিও হিন্দুধম-দশন সম্পর্কে একের পর এক বক্তৃতা দিয়ে আমেরিকা জয় করেন।তারপর যান ইউরোপ।ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি প্রভৃতি দেশ ঘুরে বেড়ান এবং বক্তৃতা দেন।তাঁর বক্তৃতা থেকে ইউরোপের মানুষ হিন্দুধম দশন সম্পর্কে নতুন করে জানতে পারেন।অনেকেই তাঁর পরম ভক্ত হয়ে যান।তাঁদের মধ্যে মার্গারেট এলিজাবেথ নোবল-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।তিনি বিবেকানন্দের আদর্শে এতটাই উদ্বুদ্ধ হন যে, নিজের জ্ন্মভূমি আয়ারল্যান্ড ছেড়ে ভারতবর্ষে চলে আসেন।বিবেকানন্দের কাছে তিনি দীক্ষা নেন।তখন তাঁর নাম হয় ভগিনী নিবেদিতা।
প্রায় চার বছর পৃথিবী ভ্রমণ করে
১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশে ফেরেন।দেশের মানুষ তাঁকে মহাসমাদরে গ্রহন করে।বিশাল সংবিধান দেয়।সংবধনা অনুষ্ঠানে তিনি দেশের মানুষকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে বলেন।সমস্ত কুসংস্কার পরিত্যাগ করতে হবে।দেশের সব মানুষকে বিভেদ ভুলে এক হতে বলেন।
বিবেকানন্দ বলতেন, সত্যই সকল ধর্মের ভিক্ত।পরোপকারই ধম, পরপীড়নই পাপ।সৎ
কম করা ধর্মের অঙ্গ।নীচ জাতি, মূখ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর সকলেই আমাদের ভাই।এদের সেবাই পরম ধম।আত্নবিশ্বাস ও ঈশ্বরে বিশ্বাস-এ- দুটি জিনিসই উন্নতি লাভের একমাএ উপায়।যুবকদের আগে শরীর গঠন করতে হবে।তারপর ধম চর্চা করবে।দুবল শরীরে ধমচর্চা হয় না।কোনো কাজই হয় না।এজন্য তাদের গীতা পড়ার আগে ফুটবল খেলতে হবে।তাতে শরীর গঠিত হবে।তখন তারা গীতা আরো ভালো বুঝবে।সবচেয়ে গুরুত্বর্পূণ কথা হলো-খালি পেটে ধম হয় না।তাই সবার আগে মানুষের দারিদ্র্য ঘোচাতে এক হবে।ঈশ্বরজ্ঞানে জীবের সেবা করতে হবে।জীবসেবা করলেই ঈশ্বর সেবা হবে।এ ব্যাপারে তাঁর বিখ্যাত উক্তিটি স্মরণ করা যেতে পারে;
বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ?
স্বামী বিবেকানন্দ তার ’’জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’’ এই বাণীর মাধ্যমে সকল জীবকে ভালোবাসতে বলেছেন।
বিবেকানন্দের কাছে উঁচু-নীচু কোনো ভেদাভেদ ছিল না।অস্পৃশ্যতাকে তিনি ঘৃণা করতেন।বিবেকানন্দ তাঁর গুরুদেব রামকৃষ্ণ পরহংসদেবের নামে একটি মঠ স্থাপন করেন।রামকৃষ্ণ মঠ।পশ্চিবঙ্গের হাওড়া জেলায় বেলুড়ে গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে এটি অবস্থিত।সাধারণভাবে এটি বেলুড় মঠ নামে পরিচিত।মানবসেবার আদশ নিয়ে এ মঠ প্রতিষ্ঠিত হয়।
গুরুদেবের আদশ প্রচারের জন্য বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ মিশনও প্রতিষ্ঠা করেন।পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের শাখা রয়েছে।এসবের প্রধান কেন্দ্র বেলুড় মঠ।বাংলাদেশে যেসব মঠ ও মিশন রয়েছে, সেসবের প্রধান কেন্দ্র ঢাকার রামকৃষ্ণ ।পৃথিবীব্যাপী এই মঠ ও মিশনের মাধ্যমে শত শত মানুষকে সেবা প্রধান করা হচ্ছে।সেবার মধ্যে রয়েছে শিক্ষা, চিকিৎসা, আপৎকালীন সাহায্য প্রদান ইত্যাদি।
বিবেকানন্দের সেবাধর্মে কোনো জাতি ভেদে বা ধমভেদ ছিল না।জাতি-ধম নির্বিশেষে তিনি সেবা প্রদান করতেন।একবার কোলকাতায় প্রচন্ড দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল।তখন রামকৃষ্ণ মিশনের পক্ষ আশ্রয়কেন্দ্র হয়েছিল।সেখানে কয়েকজন মুসলমান বালক এসেছিল থাকার জন্য।এদের কী করা হবে জানতে চাইলে বিবেকানন্দ বলেছিলেন, মুসলমান বালকেরা অবশ্যই থাকবে।শুধু তাই নয়, তাদের খাওয়া দাওয়া এবং ধমচর্চায় যাতে কোনো বিঘ্ন না ঘটে, সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।
বিবেকানন্দ কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন।কাজ ছাড়া তিনি কিছুই বুঝতেন না।তাই বিশ্রামের অভাবে অল্পদিনেই তাঁর শরীর ভেঙে পড়ে।ফলে ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে ৪ জুলাই বেলুড় মঠে তিনি দেহত্যাগ করেন।