শ্রীচৈতন্য ১৪৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারী ভারতে পশ্চিমবঙ্গের নবদ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর পিতা জগন্নাথ মিশ্র এ মাতা শচীদেবী।জগন্নাথ মিশ্রের পৈতৃক নিবাস ছিল বাংলাদেশের শ্রীট্টের (বতমান সিলেট) ঢাকা দক্ষিণ গ্রামে।বিদ্যাশিক্ষার জন্য তিনি নবদ্বীপ গিয়েছিলেন।নীলাম্বর চক্রবর্তীর কন্যা শচীদেবীকে বিয়ে করে তিনি সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।
জগন্নাথ মিশ্রের দুই ছেলে-বিশ্বরূপ ও নিমাই।এই নিমাই-ই পরবর্তীকালে শ্রীচৈতন্য বা চৈতন্যদের নামে খ্যাত হন।
নিমাইয়ের অগ্রজ বিশ্বরূপ যৌবনে ঘর ছেড়ে সন্ন্যাস গ্রহন করেন।নিমাইয়ের বয়স যখন দশ-এগার, তখন তাঁর পিতার মৃত্যু হয়।মা শচীদেবী কনিষ্ঠ পুএকে নিয়ে খুব বিপদে পড়েন।বালক নিমাই ছিলেন খুবই চঞ্চল ও দুরন্ত।তবে খুব মেধাবী।শচীদেবী তাঁকে গঙ্গাদাস পন্ডিতের চতুষ্পাঠীতে ভর্তি করিয়ে দেন।তার মেধা এবং রূপের কারণে সকলেই তাঁকে আদর করতেন।গুরু গঙ্গাদাস এমন একজন ছাএ পেয়ে খুবই খুশি।
নিমাই স্বভাবে চঞ্চল ও দুরন্ত হলে কী হবে?
পড়াশুনার বেলায় ছিলেন নিষ্ঠাবান।তাই অল্পকালের মধ্যেই তিনি ব্যাকরণ, অলংকার, স্মৃতি ও ন্যায় শাএ অগাধ পাণ্ডিত্য অজন করেন।ষোল বছর বয়সেই তিনি পন্ডিত নিমাই বলে সারাদেশে পরিচিত হয়ে ওঠেন।এ-সময় তিনি একটি টোল খুলে ছাএ পড়াতে লাগলেন।অল্পকালের মধ্যেই তাঁর অধ্যাপনার খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।পু্এের এই খ্যাতিতে মা শচীদেবী খুবই খুশি।তাঁর মনে আনন্দের ধারা বইতে লাগল।তিনি সিদ্বান্ত নিলেন ছেলের বিয়ে দিবেন।কনেও ঠিক হয়ে গেল।পন্ডিত বল্লভার্যের সুলক্ষণা কন্যা লক্ষীদেবী।শচীদেবী তখন একটি অসাধারণ কাজ করলেন।তখনকার নিয়মানুযায়ী তিনি ছেলের বিয়েতে অনেক পণ নিতে পারতেন।কিন্তু পণ প্রথার বিষবৃক্ষের মূলে তিনি কুঠারঘাত করলেন।বিনা পণে তিনি ছেলের বিয়ে দিলেন।
নিমাই যে কতবড় পন্ডিত ছিলেন তা একটি ঘটনা থেকে বোঝা যায়।সে-সময় কাশ্নীরে এক বিখ্যাত পন্ডিত ছিলেন কেশব মিশ্র।তিনি কাশি, কাষ্ণী, নালন্দা প্র্ভৃতি স্থানের পন্ডিতদের শাএবিচারে পরাজিত করে একদিন নবদ্বীপে এসে উপস্থিত হন।তিনি সগর্বে পন্ডিতদের প্রতি ঘোষণা করেন, হয় তক বিচার করুন, না হয় জয়পএ লিখে দিন।তাঁর পান্ডিত্যের কথা সবাই জানতেন।তাই নবদ্বীপের পন্ডিত-সমাজ ভীত হয়ে পড়েন।তখন তরুণ পন্ডিত নিমাই বিনয়ের সঙ্গে এগিয়ে আসেন।গঙ্গাতীরে দুজনের মধ্যে কুশল বিনিময় হয়।নিমাইয়ের অনুরোধে কেশব পন্ডিত তৎক্ষণাৎ মুখে মুখে শতাধিক শ্লোকে গঙ্গাস্তোএ রচনা করেন।এরপর নিমাই শুরু করেন তার সমালোচনা।তিনি কোনো শ্লোকে কোথায় কী ভুল আছে তা ব্যাখ্যা করেন।নিমাইয়ের সমালোচনা শুনে উপস্থিত পন্ডিতগণ বিস্মিত হয়ে যান।কেশব মিশ্রও তাঁর ভুল স্বীকার করেন।এ ঘটনার পর নবদ্বীপে নিমাইয়ের পান্ডিত্যের খ্যাতি আরো বেড়ে যায়।
নিমাই একবার পূববঙ্গ ভ্রমণে আসেন।নবদ্বীপে ফিরে গিয়ে শোনেন সর্পাঘাতে লক্ষীদেবীর মৃত্যু হয়েছে।এতে তিনি খুব আঘাত পান।সংসারের প্রতি তাঁর মন উঠে যায়।ধীরে ধীরে তাঁর মধ্যে ধর্মানুরাগ প্রবল হয়ে উঠে।এ বিষয়টি বুঝতে পেরে মা শচীদেবী সনাতন পন্ডিতের কন্যা বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে তাঁর আবার বিয়ে দেন।
কয়েক বছর সুখেই কাটে।তারপর একদিন নিমাই যান কাশীধামে।পরলোকগত পিতার আত্নার সদগতি কামনায় পিন্ডু দানের জন্য।সেখানে তিনি ঈশ্বরপরীর নিকট কৃষ্ণনামে দীক্ষা নেন।এতে তাঁর মনে বিরাট পরিবতন আসে।নবদ্বীপে ফিরে অধ্যাপনা, সংসারধম সব ছেড়ে দেন।শুধু কৃষ্ণনাম করেন।নবদ্বীপের বৈষ্ণবগণও তাঁর সঙ্গে যোগ দেন।তাঁদের মধ্যে ছিলেন নিত্যানন্দ, শ্রীবাস, গদাধর, মুকুন্দ, অদ্বৈতাচায প্রমুখ।এরা তাঁর প্রধান পাষদ।তবে নিত্যানন্দ ছিলেন সবচেয়ে কাছের।
অনুসারীদের নিয়ে নিমাই বাড়ি-বাড়ি গিয়ে, এমনকি গ্রামের পথে পথে কৃষ্ণনাম প্রচার করতে থাকেন।এতে অবশ্য অনেকে ক্ষুদ্ব হন।অনেকে বাধাও দেন।জগাই-মাধাই নামে মাতাল দুই ভাই একদিন নিমাই ও নিত্যানন্দকে আক্রমণ করেন।কিন্তু নিমাই প্রেমভক্তি দিয়ে সবাইকে আপন করে নেন।তাঁরা সকলে নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে নিমাইয়ের এ প্রেমভক্তির ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন।
এদিকে সংসারের প্রতি নিমাইয়ের মন একেবারেই উঠে যায়।তিনি সংসার ত্যাগ করার কথা ভাবেন।তারপর মাঘমাসের শুক্লপক্ষের এক গভীর রাতে তিনি মা, এী এবং ভক্তদের ছেড়ে গৃহত্যাগ করেন।কাটোয়ায় গিয়ে তিনি কেশব ভারতীয় নিকট সন্ন্যাসধর্মে দীর্ক্ষা নেন।তখন তাঁর নতুন নাম হয় শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য, সংক্ষেপে শ্রীচৈতন্য।
শ্রীচৈতন্য তাঁর প্রেমভক্তির ধম প্রচারের জন্য ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ান।পুরী, দাক্ষিণাত্য, বৃন্দাবন, কাশী প্রভৃতি স্থান ঘুরে তিনি জীবনের শেষ আটার বছর পুরীর নীলাচলে অতিবাহিত করেন।এ-সময় শ্রীরূপ, সনাতন, রঘুনাথ ভট্ট, রঘুনাথ দাস, শ্রীজীব, গোপাল ভট্ট প্রমুখ বিশিষ্ট বৈষ্ণব পন্ডিত তাঁর সঙ্গে ছিলেন।
নীলাচলে অবস্থানকালে শ্রীচৈতন্য প্রায়শই কৃষ্ণনামে উন্নাদ হয়ে থাকেন।এমনকি উন্নাদ অবস্থায় ১৫৫৩ খ্রিষ্টাদ্বের আষাঢ় মাসে একদিন তিনি জগন্নাথদেবের মন্দিরের দরজা বন্ধ হয়ে যায়।সবাই বাইরে উন্নুখ হয়ে বসে থাকেন।তারপর দরজা খুলে তাঁকে আর দেখা য়ায় না।ভেতরে শুধু জগন্নাথদেবের মৃর্তি।ভক্তদের ধারণা, শ্রীচৈতন্য জগন্নাথদেবের দেহে বিলীন হয়ে গেছে।
হিন্দুসমাজের তখন বণভেদ ও অস্পৃশ্যতা প্রবলভাবে বিদ্যমান ছিল।শূদ্র ও চন্ডালদের সবাই ঘূণা করত।কিন্তু শ্রীচৈতন্য কোনো ভেদাভেদ মানেননি।তাঁর প্রেমভক্তির ধর্মে উচ্চ-নীচ, বণভেদ ও অস্পৃশ্যতার কোনো স্থান ছিল না।তিনি আচরণালে স্থেহ বিতরণ করেছেন এবং সবাইকে বুকে স্থান দিয়েছেন।নিজে ব্রাক্ষণসন্তান হয়েও চন্ডালদের সঙ্গে একসারিতে বসে আহার করছেন।এর ফলে হিন্দুদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে যে বিভেদ ছিল, হানাহানি ছিল, তা বহুলাংশে দূর হয়েছিল।এভাবে তিনি হিন্দুসমাজকে নানা অবক্ষয় থেকে রক্ষা করেছেন।এটা তাঁর একটা বড় অবদান।
শুধু হিন্দুই নয়, তাঁর প্রেমভক্তির কাছে মুসলমান, খ্রিষ্টান ইত্যাদি জাতিভেদও ছিল না।সবাইকে তিনি প্রেম দিয়ে আপন করে নিয়েছেন।
তাই তিনি বলেছেন:::
যেই ভজে, সেই বড়, অভক্ত হীন ছাড়।
কৃষ্ণ ভজনে নাহি জাতি কুলাদি বিচার।।