মীরাবাঈ

ভারতের রাজস্থানে কুড়কি নামে একটি গ্রামে।এই গ্রামে ১৪৯৮ খ্রিষ্টাদ্বে রাঠোর বংশে মীরাবাঈ জন্মগ্রহন করেন।তাঁর পিতা রত্নসিংহ ছিলেন মেড়তার অধিপতি রাও দুধাজীর পুএ।মা বীর কুঁয়রী ছিলেন ঝালাবংশীয় রাজপুএ শূরতান সিংহের কন্যা।রত্নসিংহ কুড়কি অঞ্চলে বারোখানা গ্রামের জায়গির পেয়ে  সেখানেই গড় নির্মাণ করে বাস করতেন।

মীরা ছিলেন তাঁর পিতা-মাতার একমাএ সন্তান।তাই খু্ব আদর-যত্নে তিনি লালিত-পালিত হচ্ছিলেন।কিন্তু মাএ আট বছর বয়সে  তিনি তাঁর মাকে হারান।ফলে তাঁর জীবনে একটা ছন্দপতন ঘটে।পিতা রত্নসিংহ মেয়েকে নিয়ে অনেকটা বিপদে পড়েন।তখন পিতামহ রাও দুধাজী মীরাকে নিজের কাছে নিয়ে যান।পরম যত্নে তাঁকে লালন-পালন করতে থাকেন।দুধাজী নিজে ছিলেন একজন ধমপ্রাণ মানুষ।মেড়তার প্রাসাদের পাশে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত চতুর্ভুজজীর মন্দির।তিনি নিয়মিত সেখানে পূজাচর্না করতেন।মাঝে মাঝে মীরা সেখানে যেতেন।মন্দিরের পুরোহিত গদাধর পন্ডিত শাএালোচনা করতেন।মীরা আগ্রহভরে শুনতেন।পিতামহ দুধাজীও মাঝে মাঝে তাঁকে রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণে কাহিনী শোনাতেন।

এর ফলে ছোটবেলায় থেকেই ধমজীবনের একটা আদশ মীরার হৃদয়ে বদ্বমূল হয়ে যায়।বালিকা বয়সেই মীরা ভক্তিরসাত্নক ভজন রচনায় অসামান্য প্রতিভার পরিচয় দেন।চতুর্ভুজজীর  মন্দিরের দেয়ালে মীরার কয়েকটি উৎকৃষ্ট ভজন উৎকীণ আছে।একবার এক সাধু মীরাকে গিরিধারী গোপালের একটি বিগ্রহ দেন।মীরা সেটি প্রাসাদের নিয়ে নিত্য তার সেবা-পূজা করতেন।এর ফলে ছোটবেলা থেকেই কৃষ্ণের প্রতি মীরার গভীর শ্রদ্বা ও ভলোবাসার সৃষ্টি হয়।

মীরা যৌবনে পা দিলেন।রূপলাবণ্যে তিনি অনন্যা।পিতামহ দুধাজী নাতনির বিবাহ ঠিক করলেন।পাএ চিতোরের রাণা সংগ্রামসিংহের পুএ ভোজরাজ।১৫১৬ খ্রিষ্টাদ্বে মহাসমারোহে মীরার বিবাহ হয়ে গেল।তিনি চলে গেলেন শুশুর বাড়ি।

শুশুর বাড়িতে কোনো কিছুই অভাব নেই।রাণা সংগ্রামসিংহের মতো শুশুর।ভোজরাজের মতো সুযোগ্য স্বামী।অতুল ঐশ্বয অসংখ্য দাস-দাসী।কিন্তু এসবের প্রতি মীরা কোনো আসক্তি ছিল না।জীবনে তাঁর কাম্য হলো কৃষ্ণপ্রেম আর গিরিধারীলালের সাক্ষাৎ লাভ।তিনি শুধু সাধন-ভজন নিয়েই থাকেন।প্রাসাদে কোনো সাধু-সক্ত এলে ছুটে যেতেন তাঁর কাছে।একমনে হরিকথা শুনতেন।কখনো কখনো ভাবাবিষ্ট হয়ে নিজের কন্ঠেই শুরু করতেন ভজন গান।তাঁর কন্ঠ এক মধুর ছিল যে সবাই মন দিয়ে তা শুনতেন।ভোজরাজ এী প্রতি ছিলেন উদার ও সহনশীল।তিনি এীর মনের কথা বুঝতে পারেন।তার একটি কৃষ্ণমন্দির নির্মাণ করে সেখানে কৃষ্ণের বিগ্রহ স্থাপন করে দেন।মীরা এতে খুব খুশি হন।স্বামী প্রতি তাঁর শ্রদ্বা-ভক্তি বেড়ে যায়।কৃষ্ণভজনে সময় কাটেকিন্তু তাঁর।সংসারের প্রতি তাঁর কোনো  ছিল না আগ্রহ।এতে আত্নীয়-পরিজন ও প্রাসাদের লোকজনের মধ্যে সমালোচনা ও নিন্দা শুরু হয়ে যায়।

ক্রমশ মীরার মধ্যে কৃষ্ণপ্রেমের ব্যাকুলতা বৃদ্বি পায়।রাজবধূর বেশে তিনি যেন এক সবত্যাগিনী তপস্বিনী।দিনে রাতে প্রায় সময়ই তিনি ভজন-পূজনে ব্যস্ত থাকেন।ইষ্টদের গোপীনাথের জন্য মাঝে মাঝে কাঁদতে থাকেন।এরূপ অবস্থায় ভোজরাজ একদিন এীকে ডেকে বলেন-তোমার প্রাণের বেদনা কোথায়,  প্রাণের আকৃতি কী তা খুলে বল।বল, তুমি কী চাও।কী পেলে তুমি সুখী হবে, কিসে শান্তি লাভ করবে তা আমায় বল।

মীরা তখন মধুর কন্ঠে একটি ভজন গেয়ে তার উওর দিলেন;

মেরে ত গিরিধর ‍গোপাল, দুসরো ন কোই

জাঁতে শির মোর মুকুট মেরে পতি সোই।

গিরিধারী ‍গোপাল ছাড়া  কেউ নাই আমার।তিনিই আমার পতি যাঁর মাথায় ময়ূর-মুকুট ।

ভোজরাজ এীর সঙ্গীত শুনে মুগ্ধ হলেন।তাঁ মনের কথা বুঝতে পারলেন।তিনি মীরার সাধন-ভজনে সার্বিক সহযোগিতা করতে লাগলেন।

এদিকে রাজবধূ মীরার কৃষ্ণপ্রেমের ব্যাকুলতার কথা চিতোরের সাধারণ মানুষ এবং সাধু-সন্ন্যাসীরা জেনে গেছেন।তাঁরা মীরাকে রাজমহিষী নয়, বরং ভক্তিসাধিকা মীরাবাঈ বলে জানালেন।মীরার সুমধুর কন্ঠের সঙ্গীত এবং প্রেম সাধনার কথা সমস্ত রাজস্থানেই প্রচারিত হলো।

এই অবস্থায় ১৫২৮ খ্রিষ্টাব্দে ভোজরাজ হঠাৎ মারা যান।এর অল্পকাল  পরে শুশুর রাণা সংগ্রামসিংহও মারা যান।তখন চিতোরের নতুন রাণা হন বিক্রমজিৎ সিং।তিনি মীরার ওপর নানা অত্যাচার করতে থাকেন।তাঁকে মেরে ফেরারও চেষ্টা করা হয়।কিন্তু তাঁর আরাধ্যা গিনিধারী কৃপায় তিনি রক্ষা পান।শেষপযন্ত মীরাবাঈ পিতৃগৃহ মেড়তায় ফিরে যান।সেখান থেকে চলে যান বৃন্দাবনে।তখন শ্রীরূপ গোস্বামী গৌড়ীয় বৈষ্ণবমন্ডলীয় আর্চায।মীরা তাঁর দশন কামনা করেন।কিন্তু আর্চায এীলোকদের দশন দিতে রাজি হন নন।

তখন মীরা বলেন, গোস্বামীজী কি ভাগবতের  কথা বিস্মৃত হয়েছেন?

বৃন্দাবনের একমাএ পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ।আর সকলেরই প্রকৃতি।তবে তও্ব্দর্শী গোস্বামীজী আমাকে দশন দিতে এত কুন্ঠিত কেন?

মীরার তও্বর্পূণ কথা শুনে শ্রীরূপ গোস্বামী প্রীত হন এবং মীরার সঙ্গে কৃষ্ণকথা বলেন।মীরার কৃষ্ণ-ব্যাকুলতা গোস্বামীকে মুগ্ধ করে।

বৃন্দাবনে এসে মীরা তীব্রভাবে প্রেমভক্তিতে আপুত হয়ে পড়েন।দিকে দিকে তাঁর নাম প্রচারিত হয়।রাজস্থান ও উওর-পশ্চিম ভারতে মীরার নাম সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।কৃষ্ণ ভক্তিপরায়ণা মীরাবাঈ ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে ভগবান প্রাপ্তির পথ প্রদশন করেন।তাঁর রচিত ভজন-সঙ্গীত কৃষ্ণপ্রেমের গান,কৃষ্ণের উপাসনা এবং ভগবৎ সাধনার এক নতুন পথ প্রদশন করে।এই সঙ্গীতধারা হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির সৃষ্টি করে।এই সম্প্রীতি যে মিলনধারায় প্রকাশ লাভ করে, তার নাম ভক্তিবাদ।হিন্দুধর্মের ভাগবতধম ও ভক্তিবাদ এবং ইসলামের সুফীবাদের সকল শ্রেনির মানুষ সমান চোখে দেখা হয়।

অতঃপর একদিন বৃন্দাবনের লীলা সাঙ্গ করে মীরা কৃষ্ণের স্মৃতিবিজড়িত দ্বারকার উদ্দেশে যাএা করেন।দ্বারকাধামে এসে রণছোড়জীর বিগ্রহের ভজন-পূজনেই জীবনের শেষ দিনগুলো অতিবাহিত করেন।এই দ্বারকাধামেই তাঁর দেহলীলা সংবরণ হয়।

মীরাবাঈয়ের জীবনী থেকে আমরা এই শিক্ষা পাই যে, যাঁরা প্রকৃত সাধক তাঁরা জাগতিক সবকিছুই উর্ধ্বে উঠে যান।দৈহিক রূপ-লাবণ্য, পার্থিক বিষয়ে-আশয়, সুখ-সাচ্ছন্দ্য তাঁদের চিওকে আকষণ করে না।সবকিছু ছেড়ে কাম্য বস্তকে লাভ করার জন্য একাগ্রচিওে সাধনা করেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top