মেহেরপুর জেলায় অন্তগত কুতবপুর একটি গ্রাম।সেই গ্রামে বাস করতেন ভুবনমোহন ভট্টার্চায নামে একজন সদাচারী ব্রাক্ষণ।তাঁর স্ত্রী নাম মাণিক সুন্দরী।উভয়ই নিয়মিত গূজা-পাবণ ও ব্রতাচার নিয়ে থাকেন।
মাণিক সুন্দরীর পিত্রালয় মেহেরপুরেরই অন্তগত রাধাকান্তপুর গ্রামে।এই গ্রামেই ১২৮৭ সালে (১৮৮০ খ্রিষ্টাদ্ব) ঝুলন পূর্ণিমার রাতে মাতুলালয়ে ঠাকুর নিগমানন্দ জন্মগ্রহণ করেন।তার চোখ দুটি ছিল পদ্ন বা নলিনীর মতো দেখতে।তাই তাঁর নাম রাখা হয় নলিনীকান্ত।নলিনীকান্ত ভট্টার্চায।
নলিনীর বয়স তখন সাত বছর ।পিতা ভুবনমোহন ছেলেকে ভর্তি করিয়ে দেন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।খেলাধুলা ও দুরন্তপনার পাশাপাশি নলিনী পড়াশোনায়ও মেধার পরিচয় দিয়ে আসছিলেন শুরু থেকেই।তাঁর প্রাথমিকের পাঠ তিনি সাফল্যের সঙ্গেই শেষ করেন।ভর্তি হন তিনি দারিয়াপুর গ্রামের ইংরেজি বিদ্যালয়ে মধ্যএরপর।রাধাকান্তপুরে মাতুলালয়ে থাকতেন।
একাদশ বছর বয়সে নলিনীর উপনয়ন হয়।তখন থেকেই তাঁর মধ্যে ধমভাব জেগে ওঠে।তিনি এীসন্ধ্যা গায়এী ম্ত্র জপ করতেন।নিয়মিত রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি পাঠ করতেন।কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর মধ্যে একটা পরিবতন লক্ষ্য করা যায়।তিনি জাতিভেদ মানেন না।ব্রাক্ষণের মিথ্যা অহংকারকে ঘৃনা করেন।তবে প্রকৃত সম্মানিত ব্যক্তিকে সম্মান করেন।যুক্তি দিয়ে তিনি নিজের মতকে সমথন করেন।কিন্তু নিজের মত ঠিক নয় বুঝতে পারলে তিনি নির্দ্বিধায় পরাজয় স্বীকার করেন।ধর্মের নামে ভন্ডামিকে তিনি তীব্রভাবে ঘৃণা করেন।
সাহিত্যসম্রট বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন সম্পর্কে নলিনীর দাদামশাই।তিনি নলিনীকে খুর স্নেহ করতেন।নলিনীও তাঁকে খুব ভালোবাসতেন এবং শ্রদ্ধা করতেন।দুজনের মধ্যে অনেক বিষয়ে কথা হতো।এর মধ্যে দিয়ে নলিনীর বঙ্কিমচন্দ্রের নিকট থেকে অনেক কিছু শিখেছিলেন।নলিনীর ইংরেজী পরীক্ষা আগেই বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যু হয়।কিছুদিন পর মা মাণিক সুন্দরীও পরলোক গমন করেন।এ-দুটি ঘটনা নলিনীর মনে গভীর রেখাপাত করে।মানব জীবনের নশ্বরতা তাঁকে ভীষণভাবে ভাবিয়ে তোলে।
পরীক্ষায় উর্ওীণ হওয়ার পর নলিনীর মধ্যে বিরাট পরিবতন লক্ষ্য করা যায়।দেব-দ্বিজে, ধর্মে-কর্মে শাস্ত্রাদিতে তাঁর বিশ্বাস উঠে যায়।ভগবানের বিশ্বাস নেই।ঝোঁপ দেখা দেয় যাএা-থিয়েটার আর সাহিত্যচর্চায়।পাশাপাশি চলে জনসেবার কাজ।জার্তি-ধম-বণ নির্বিশেষে সকলের বাড়ি গিয়ে রোগীর সেবা করেন।কোনো বাড়িতে মৃতদেহ সংকারে লোক পাওয়া না গেলে নলিনী সেখানে সাগ্রহে এগিয়ে যান।এ নিয়ে পাড়া- প্রতিবেশীদের কাছ থেকে পিতা ভুবনমোহনকে অনেক নিন্দাবাক্য শুনতে হয়।
নলিনীর এই আচরণ দেখে ভুবনমোহন খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন।পুএকে সংসারের আবদ্ব করার জন্য তিনি তাঁর বিবাহ দেয়ার সিন্ধান্ত নেন।যথাসময়ে নলিনীর বিয়ে হয়ে যায়।কন্যা হালিশহরের বৈদনাথ মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে সুধাংশুবালা।নলিনীর বয়স তখন ১৭ এবং সুধাংশুবালার ১২।
বিয়ের কিছুদিন পর নলিনীকান্ত সিন্ধান্ত নিলেন উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করবেন।তাই পিতার অনুমতি নিয়ে তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন।এখানে কিছুদিন পড়ার পর তিনি ঢাকার সার্ভে স্কুলে ভর্তি হন।কারণ, এখান থেকে পাশ করলে সহজেই চাকরি পাওয়া যায়।এখান থেকে পাশ করার পর তিনি ফিরে যান স্বগ্রামে এবং শিক্ষকতা শুরু করেন কুতবপুর স্কুলে।কিছুদিন পর ওভারসিয়ারের চাকরি নিয়ে যোগদান করেন দিনাজপুর সরকারি অফিসে।কিন্তু এই চাকরিতে মিথ্যাচার করতে হয় বলে তিনি চাকরি পরিবতন করেন।তারপর আরেক দফা চাকরি পরিবতন করে তিনি কোলকাতার জনৈক জমিদারের এস্টেটে চাকরি নেন।সেই উপলক্ষে তিনি তখন কোলকাতায় ছিলেন।স্ত্রী সুধাংশুবালা তখন অন্তঃসও্বা।তাই তাঁকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন।সেখানে তাঁর একটি কন্যা সন্তান জন্মে।কয়েকদিন পর কন্যা সন্তানটি মারা যান।স্ত্রীও বেশ কিছুদিন রোগ ভোগের পর মারা যান।এতে নলিনী খুব আঘাত পান।সংসারের প্রতি তাঁর মন উঠে যায়।তিনি চাকরিও ছেড়ে দেন।প্রায়শই তিনি স্ত্রী সুধাংশুবালার ছায়ামূর্তি দেখতে পান।তিনি এর রহস্য জানতে চান।পরলোক সম্পর্কে চর্চা শুরু করেন।এমন সময় একদিন কোলকাতায় পূর্ণানন্দ পরমহংসের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়।পূর্ণানন্দ বলেন, স্ত্রীমাস্ত্রেই আদ্যাশক্তি মহামায়ার অংশ।তাঁকে পেতে হলে সাধনা করতে হবে।
এরপর নলিনী যান বীরভূমের মহার্তীথ তারাপাঠ।সেখানে ছিলেন মহাসাধক বামাক্ষেপা।তিনি তাঁকে তারামস্ত্রে দীক্ষা দেন।আর বলেন তারামায়ের সাধনা করতে।নলিনী একমনে সাধনা করতে লাগলেন।অবশেষে স্ত্রীরূপে দেখা দিলেন।কিন্তু নলিনী তাঁকে ধরতে গেলেই তিনি মিলিয়ে যান।
এ-কথা তিনি বামাক্ষেপাকে খুলে বললেন,
এ দেবীকে আমিই বা কে?
বামা বললেন, এ তও্ব জানতে হলে তোকে জ্ঞান সাধনা করতে হবে।জ্ঞানীগুরুর সন্ধান করতে হবে।
বামাক্ষেপার কথামতো নলিনী জ্ঞানীগুরুর সন্ধানে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন।ঘুরতে ঘুরতে পুষ্করতীর্থে এসে জ্ঞানীগুরুর সন্ধান পান।তিনি হলেন সচ্চিদানন্দ পরমহংস।তাঁর আশ্রমে থেকে নলিনী বেদ-বেদান্ত, দশনশাস্ত্রাদি অধ্যয়ন করেন।গুরু তাঁকে বৈদিক সন্ন্যাস মন্ত্রে দীক্ষা দেন।তখন তাঁন নতুন নাম হয় স্বামী নিগমানন্দ সরস্বতী।তারপর তিনি ভারতের বিভিন্ন র্তীথন্থান ঘুরে বেড়ান।যেমন-কাশী, কামাখ্যা, হিমালয় কোকিলামুখ ইত্যাদি।এসব জায়গায় তিনি যোগ সাধনা করেন।
এরপর জনহিতার্থে ঠাকুর নিগমানন্দ সদধম প্রচার করেন।ভারতের বিভিন্ন স্থানে তিনি মঠ ও আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন।সেখানে ব্রক্ষচয সাধনার ব্যবস্থার করেন।কারণ তিনি উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন যে, প্রথম জীবনে ব্রক্ষচয পালন না করলে পরবর্তী জীবন সুন্দরভাবে গড়ে উঠতে পারবে না।পাশাপাশি তিনি আদশ গৃহস্থ জীবন গঠনের ওপরও জোর দেন।এছাড়া ঠাকুর কৃষিকম, গো-সেবা, অনাথ আশ্রম, ঋষি বিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং দাবত্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেও জনসেবার দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।
ঠাকুর তাঁর আদশ প্রচারের জন্য আর্য্য-দপণ নামে একটি মাসিক পএীকা প্রকাশ করে গেছেন,যা এখনও নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে।এটি সনাতন ধর্মের মুখপএ হিসেবে পরিচিত।এছাড়া ঠাকুর যোগীগুরু, জ্ঞানীগুরু তান্ত্রিক গুরু প্রেমিক গুরু, ব্রক্ষচয সাধন, বেদান্তবিবেক, তও্বমালা প্রভৃতি গ্রন্থ রচনার মাধ্যমেও তাঁর আদশ প্রচার করে গেছেন।
ঠাকুর নিগমানন্দের দশন ছিল-শঙ্করের মত ও গৌরাঙ্গের পথ, অর্থাৎ সেবা ও ভক্তির পথে অদ্বৈত ব্রক্ষজ্ঞান লাভ করা।এই আদশ প্রচারের বাংলার চারদিকে চারটি সারস্বত আশ্রম সুন্ত্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে।বাংলাদেশের সদধম প্রচারের জন্য সহস্রাধিক সারস্বত সঙ্ঘ আছে।
তন্ত্র, জ্ঞান, যোগ প্রেম-এই চতুঃসাধনের সিদ্ধ মহাসাধক নিগসানন্দ ১৩৪২ সালের (১৯৩৫ খ্রিষ্টাদ্ব) ১৩ ই অগ্রহায়ণ শুক্রবার অপরাহু ১:১৫ মিনিটে ইহলীলা ত্যাগ করেন।
ঠাকুরের কয়েকটি বাণী::
১.আদশ গাহস্থ্য জীবন প্রতিষ্ঠাই আমার উদ্দেশ্য।প্রাচীন ঋষিগণ প্রবতির্তে পথে চলে তোমরা আদশ গৃহস্থ হও।শুধু সন্ন্যাসী হয়ে বনে গেলেই ভগবান লাভ হয় না।গৃহে থেকে আদশ হয়ে ধম সাধনা করলেও ভগবান লাভ হয়।
২.আত্নজ্ঞান কিংবা নারায়ণ জ্ঞানে যথাসাধ্য জীবসেবা কর।পরের উপকার করতে কুষ্ঠিত হয়ো না।এই প্রত্যক্ষ ধম ত্যাগ করলে আধ্যাত্নিক শক্তি লাভ হয় না।জীবসেবাই কলির একমাএ ধম।
৩.নর-ই সাক্ষাৎ নারায়ণ।সুতরাং নরের সেবা ব্যতীত নারায়ণের কৃপা হয় না।তাই গাহস্থ্য ধর্মের এত মাহাত্ন্য।আপন প্রাণকে বিশ্ব-প্রাণের সঙ্গে মেলাতে হবে।তবেই ভগবান যেচে দয়া করবেন।নতুবা মুখের র্প্রাথনায় তাঁর সিংহাসন টলে না।
৪.কেবল কতগুলো কর্মানুষ্ঠানে জীবনে র্পূণতা লাভ হয় না।ভগবানে আত্নানিভর করতে অভ্যাস কর।কীট থেকে ব্রক্ষ পযন্ত একই ভগবানের বিকাশ জেনে সবভূতের হিত সাধনে জীবন উৎসগ কর।মানব জীবন ধন্য হবে।পবিএ আনন্দের অধিকারী হবে।