বৈষ্ণবীয় রাসযাত্রা উৎসবের তাৎপর্য এবং কেন পালন করা হয়

কার্তিক পূর্ণিমা তিথিতে পালিত হবে রাস পূর্ণিমা এই বিশেষ দিনে ভক্তি ও নিষ্ঠার সঙ্গে রাস উত্‍সব পালন করা হয়। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে এই বিশেষ দিনেই রাধা ও অন্য গোপীনিদের সঙ্গে রাসলীলায় মেতে উঠেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ । শ্রীমদ্ভাগবতের মতে, কৃষ্ণ যোগমায়াকে সমীপে গ্রহণ করেই রাস অনুষ্ঠান করেছিলেন ।

শ্রীকৃষ্ণের সুমধুর বংশীধ্বনিতে মুগ্ধ হয়ে গোপিনীবৃন্দ নিজেদের কর্তব্যকর্ম বিসর্জন দিয়ে সংসারের সকল মোহ পরিত্যাগ করে বৃন্দাবনে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং শ্রীকৃষ্ণের চরণে নিজেদের সমর্পন করেছিলেন। প্রথমে শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের নিজেদের গৃহে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। কিন্তু গোপিনীরা নিজেদের মতে দৃঢ় ছিলেন, ভগবান ভক্তের অধীন। শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের ভক্তি দেখে তাদের মনোকামনা পূরণের জন্য রাসলীলা আরম্ভ করেন।

কিন্তু যখনই শ্রীকৃষ্ণ তাদের অধীন বলে ভেবে গোপিনীদের মন গর্ব-অহংকারে পূর্ণ হল, তখনই শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের মধ্য থেকে অন্তর্ধান হয়ে গেলেন। শ্রীকৃষ্ণ শুধু রাধাকে নিয়ে উধাও হলেন, কারণ রাধা তো শ্রীকৃষ্ণের এর একটি অংশ তখন গোপিনীবৃন্দ নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন। ভগবানকে ‘একমাত্র আমার’ বলে ভেবে অহংকারের ফলে শ্রীকৃষ্ণকে তারা হারিয়ে ফেলেছিলেন। যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ ত্রিজগতের পতি, তাই তাকে কোনো মায়া-বন্ধনে বেঁধে রাখা যায় না। তখন গোপিনীবৃন্দ একাগ্রচিত্তে শ্রীকৃষ্ণের স্তুতি করতে শুরু করেন। ভক্তের ভক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান গোপিনীদের মানব জীবনের পরমার্থ বুঝিয়ে দিয়ে তাদের অন্তর পরিশুদ্ধ করেন।

গোপিনীদের ইচ্ছাকে তিনি সম্মান জানিয়ে ‘যতজন গোপিনী, ততজন কৃষ্ণ’ হয়ে গোপিনীদের মনের অভিলাষ পূর্ণ করেছিলেন আর গোপীবৃন্দও জাগতিক ক্লেশ থেকে মুক্তিলাভ করেছিলেন। এইভাবে জগতে রাস উৎসব প্রচলন ঘটে। প্রতি বছর কার্তিক পূর্ণিমা তিথিতে পালন করা হয় রাধা কৃষ্ণের প্রেমের উৎসব রাস পূর্ণিমা।

এই বছর আগামী ২৭ নভেম্বর ২০২৩ সোমবার পালিত হবে রাস পূর্ণিমা। হেমন্ত ঋতুর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হল রাস, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধা এই দিনটিতে পূজিত হন। বৈষ্ণব তীর্থক্ষেত্র ও বিভিন্ন কৃষ্ণ মন্দিরগুলিতে মহা সমারোহ সহকারে রাস উৎসব পালন করা হয়।

রাস পূর্ণিমার তারিখ ও সময়

  • এই বছর রাস পূর্ণিমা শুরু হচ্ছে ২৬ নভেম্বর ২০২৩ রবিবার সকাল ১১.২৩ মিনিটে৷
  • পূর্ণিমা ছেড়ে যাচ্ছে ২৭ নভেম্বর ২০২৩ সোমবার সকাল ১০.১৫ মিনিটে৷
  • উদয়া তিথি অনুসারে রাস পালন করা হবে ২৭ নভেম্বর সোমবারে।

রাস উত্‍সবের উত্‍পত্তি


এটি বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের কাছে অন্যতম প্রধান উৎসব। পুরাণ অনুসারে বৃন্দাবনে থাকাকালীন শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে তিনি তাঁদের মনের সব ইচ্ছে পূরণ করবেন এবং তাঁদের সঙ্গে রাসলীলা করবেন। সেই প্রতিজ্ঞা রাখতেই কার্তিক পূর্ণিমা তিথিতে রাধা ও অন্য গোপিনীদের সঙ্গে রাসলীলা করেছিলেন কৃষ্ণ। সেই থেকে শুরু হয় রাস উৎসব ।

রাস উৎসব ইতিহাস


প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে রস থেকেই রাস কথাটি এসেছে। প্রেমের রসে মাখা এই উৎসব তাই রাস নামে পরিচিত। শোনা যায় স্বয়ং শ্রীচৈতন্যদেব নবদ্বীপে এই উৎসব সূচনা করেন। অনেকের মতে, ঈশ্বরের সঙ্গে আত্মার মহামিলনই রাস। পুরাণে শারদ রাস ও বসন্ত রাসের উল্লেখ রয়েছে। এটি সনাতন ধর্মালম্বীদের একটি বাৎসরিক উৎসব। শ্রীকৃষ্ণের ব্রজলীলার অনুকরণে বৈষ্ণবীয় ভাবধারায় এই উৎসব পালন হয়।

মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রে পরবর্তী সময়কালে বাংলায় রাস উৎসবের বহুল প্রচলন ঘটে। নদিয়ার শান্তিপুর ও নবদ্বীপে টানা তিন থেকে চারদিন মহা সমারোহে পালিত হয় রাস উৎসব। উৎসবের শেষ দিন বের হয় শোভাযাত্রা। ভারতের উত্তরপ্রদেশের মথুরা ও বৃন্দাবনে, পশ্চিমবঙ্গের নদীয়াতে শান্তিপুরে ও নবদ্বীপ সহ অন্যান্য জায়গায়, এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য শান্তিপুরের মূল উৎসব হলো রাস। ওড়িশা, আসাম ও মণিপুরে রাসযাত্রার উৎসব বিশেষভাবে উদযাপিত হয়।

রাস পূর্ণিমার তাৎপর্য


এই পূর্ণিমা তিথি কার্তিক পূর্ণিমা নামেও পরিচিত। মনে করা হয় এই পূর্ণিমায় উপবাস করলে একশো অশ্বমেধ যজ্ঞের সমান পূণ্যফল লাভ করা যায় এবং এই দিনে সূর্যোদয়ের আগে ব্রাহ্ম মুহূর্তে স্নান করা শুভ বলে ধর্মীয় বিশ্বাস। হিন্দুধর্মে এই পূর্ণিমার বিশেষ মাহাত্ম্য রয়েছে। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে এই দিনে ভগবান শিব ত্রিপুরাসুর নামে এক রাক্ষসকে বধ করেছিলেন। তাই এই পূর্ণিমা ত্রিপুরী বা ত্রিপুরারি পূর্ণিমা নামেও অনেক জায়গায় পরিচিত। আবার অন্য একজন বলেছেন যে এই দিনে শ্রীবিষ্ণু মৎস্য অবতার গ্রহণ করেছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *