পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার জয়রামবাঢী গ্রামে সারদা দেবীর জন্ম।সে দিন ছিল বাংলা ১২৬০ সালের (১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দ)১৮ পৌষ বৃহস্পতিবার।পিতারাম চন্দ্র মুখোপাধ্যায়, মাতাশ্যামা সুন্দরী।জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয় ঠাকুরমণি দেবী।
মা নাম রাখেন ক্ষেমাঙ্করী।স্নেয়ময়ী মাসি নাম রাখেন সারদা।
মাসির রাখা নামেই পরবর্তীকালে তিনি খ্যাতি লাভ করেন
সারদা দেবী ছিলেন তাঁর প্রথম সন্তান।তাঁর আরো একটি বোন ও পাঁচটি ভাই ছিল।
সারদা দেবীদের পরিবার সচ্ছল ছিল না।সামান্য জমি-জমার ফসল এবং পিতা পৌরোহিত্য করে যা অজন করতেন, তা দিয়ে কোনোরকমে সংসার চলত।
সেকালে সারাক্ষণ লোকের ধারণা ছিল, মেয়েরা লেখাপড়া করলে আর সংসারের কাজ করবে না।
তাই পিতা রামচন্দ্র সারদা দেবীর লেখাপড়ার প্রতি ছিলেন উদাসীন।কিন্তু সারদা দেবী নিজের উৎসাহে ভাইদের গ্রামের পাঠশালায় যেতেন।এভাবে তিনি কিছু কিছু পড়তে শিখেছিলেন, তিনি লিখতে শেখেননি।তবে কথক ঠাকুরদের কথা, কীতন প্রভৃতি শুনে শুনে তিনি নানা বিষয়ে অনেক জ্ঞান লাভ করেছিলেন।
কামারপুকুর গ্রামের স্বামীর সান্নিধ্য খুব একটা পাননি।তাঁদের দাম্পত্যজীবনে ও র্দীঘ ছিল না।বিয়ের বছর দেড়েক পরে শ্রীরামকৃষ্ণ চলে আসেন দক্ষিণেশ্বরে।সারদা দেবী চলে যান পিএালয়ে।দুই বছর পর জয়রামবাঢীতে তাঁদের আবার সাক্ষাৎ হয়।সেখানে কিছুদিন থেকে শ্রীরামকৃষ্ণ আবার দক্ষিণেশ্বরে চলে আসেন।র্দীঘ সাত বছর পর শ্রীরামকৃষ্ণ জন্মভূমির কামারপুকুর দশনে যান।সেখানে সারদা দেবী সঙ্গে তাঁর পুনরায় সাক্ষাৎ হয়।এ সময় শ্রীরামকৃষ্ণ সারদা দেবীকে জীবনের কতব্য ও ঈশ্বর সর্ম্পকে অনেক উপদেশ দেন।তিনি বলেন, ঈশ্বর সকলেরই অতি আপনার।যে তাঁকে মনে-প্রাণে ভালোবেসে, ডাকে সে-ই তাঁর দেখা পায়।তুমি যদি ডাক, তুমিও তাঁর দেখা পাবে।তাঁর দেখা পাওয়াই জীবনের উদ্দেশ্য।
স্বামী এই উপদেশ সারদা দেবীর অন্তর স্পশ করে।তিনি একে মন্তরূপে গ্রহণ করে সাধনার পথে যাএা শুরু করেন।অন্য এীলোকদের মতো তিনি নিজেকে সংসার-বন্ধনে আবদ্ধ করেননি।স্বামীকে ছেড়ে দিয়েছেন সাধনার জগতে।
সাত মাস পরে শ্রীরামকৃষ্ণ আবার দক্ষিণেশ্বরে চলে আসেন।সারদা দেবী চলে যান পিএালয়ে।তারপর র্দীঘ কেটে যায়।স্বামীর চিন্তায় সারদা দেবী উদ্বিগ্ন হয়ে পরেন।তিনি সিন্ধান্ত নেন দক্ষিণেশ্বরে যাবেন।পিতাকে তাঁর মনোভাব জানান।রামচন্দ্র মেয়েকে নিয়ে রওনা হন।সেটা ১৮৭২ খ্রিষ্টাদ্ব।ফাল্গুনী পূর্ণিমায় কোলকাতায় গঙ্গাতীরে গঙ্গাস্নান উৎসব হবে।এই উৎসবকে সামনে রেখেই তাঁরা যাএা শুরু করেন। অনেক কষ্ট করে পায়ে হেঁটে তাঁরা দক্ষিণেশ্বরে পৌছান।
দক্ষিণেশ্বরে এসে সারদা দেবী স্বামীর সেবা-যত্নে মন-প্রাণ ঢেলে দেন।স্বামীর সাধনায় যাতে কোনোরকম বিঘ্ন না ঘটে, সে ব্যাপারে তিনি সতত যত্নশীল।তিনি নিজেও স্বামীর উপদেশ মতো কঠোর সাধনায় মগ্ন হন।এর ফলে সকলের কাছে তাঁর নতুন পরিচয় হয় শ্রীমা বলে।
সারদা দেবীও তাঁর আচার-আচরণ ও সাধন-ভজনের মাধ্যমে শ্রীরামকৃষ্ণের যোগ্য সহধর্মিণী হয়ে ওঠেন।সকলেই তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা-ভক্তি করত।তিনি সকলকে সন্তানের ন্যায় স্নেহ করতেন।এভাবে স্বামী-এী মিলে ঈশ্বর সাধনায় আত্নানিয়োগ করেন।
১২৯৩ সালের ৩১ শ্রাবণ (১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগষ্ট)
শ্রীরামকৃষ্ণ পরলোক গমন করেন।জীবনসাথীকে হারিয়ে শ্রীমা যেন একেবারে একা হয়ে যান, যদিও তাঁর ভক্ত-সন্তানেরা সব সময় তাঁকে ঘিরে থাকতেন।মনের শান্তির জন্য কিছুদিন পরে শ্রীমা র্তীথ
ভ্রমণ শুরু করেন।এ উপলক্ষে তিনি কাশী, বৃন্দাবন, পুরী প্রভৃতি র্তীথস্থান ভ্রমণ করে আসেন।এতে তাঁর মন অনেকটা শান্ত হয়।
সারদা দেবী শিক্ষিত ছিলেন না।কিন্তু তাঁর মনটা ছিল খুব উদার।তাঁর মধ্যে কোনো কুসংস্কার ছিল না।এর প্রমাণ পাওয়া যায় ভগ্নী নিবেদিতার একঠি ঘটনার।বিবেকান্দন একদিন নিবেদিতাকে পাঠিয়েছেন সারদা দেবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে।তিনি গেছেন।তাঁর আগে একজন শিষ্য গিয়ে সারদা দেবীকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি এই মেমসাহেবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন কি-না।উওরে সারদা দেবী বললেন, নরেন একটি শ্বেতপদ্ন পাঠিয়েছে।
তা কি আমি না নিয়ে পাড়ি?
সেকালে কতটা উদার হলে একজন বিদেশিনীকে এভাবে আপন করে নেয়া যায়?
শেষ বছরে শ্রীমা খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে।শিষ্য সারদানন্দকে ডেকে বলেন, আমার বোধ হয় যাবার সময় হলো।এর কিছুদিন পর ১৩২৭ সালের (১৯২০খ্রিষ্টাব্দ)৪ শ্রাবণ মা সারদা নশ্বর দেহ ত্যাগ করেন।বেলুড় মঠে তাঁর দেহের সৎকার করা হয়।পরের বছরে সেখানে একটি মাতৃমন্দির নির্মিত হয়।
সারদা দেবীর কয়েকটি উপদেশ
১.পৃথিবীর মতো সহ্যগুন চাই।পৃথিবীরা ওপর কত রকমের অত্যাচার হচ্ছে, পৃথিবী অবোধ সব সইছে, মানুষেরও সেই রকম চাই।
২.যদি শান্তি চাও,কারও দোষ দেখ না, দোষ দেখবে নিজের।জগৎকে আপনার করে নিতে শেখ, কেউ পর নয়, জগৎ তোমার।
৩.সাধন বল, ভজন বল প্রথম বয়সেই করে নেবে।শেষে কি আর হয়?যা করতে পার এখন কর।