একটি প্রাচীন সংস্কৃত মহাকাব্য রামায়ণ।রামায়ণের রচয়িতা ঋষি বাল্মীকি ।অযোধ্যার রাজা দশরথের পুত্র রামচন্দ্রের জীবন-কাহিনী রামায়ন এর মুখ্য বিষয়।রামায়ণের বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা আছে, তার মধ্যে অভিশাপও উল্লেখযোগ্য।অভিশাপের অনেক ক্ষমতা।সাধারণত বলা যায়- কেউ ক্রুদ্ধ হয়ে, , বা লাঞ্ছিত হয়ে অভিশাপ প্রদান করে দুঃখিত হয়ে।
১.রাজা দশরথকে শ্রবন কুমারের পিতামাতার অভিশাপ
শ্রবণ কুমার তার পিতা-মাতার প্রতি অত্যন্ত অনুগত এবং কর্তব্যনিষ্ঠ ছিলেন। শ্রবণ কুমার যখন বাল্য থেকে কৈশোর অবস্থা পান তখন তার মা-বাবার তীর্থভ্রমণের ইচ্ছা জাগে। সাধারণত শ্রবণ নিজে মা-বাবাকে একটি ভারে তুলে এদিকে সেদিকে নিয়ে যেতেন। মা-বাবার তীর্থ ভ্রমণের ইচ্ছা পূরণের জন্য তিনি তাদের তীর্থস্থানে নিয়ে যাওয়ার অবস্থায় একটি গাছের তলায় বিশ্রামকালে নদী থেকে জল আনতে যান৷ সেই সময়ে অযোধ্যার রাজা দশরথ শিকারের উদ্দেশ্যে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। দশরথ রাজা শব্দভেদী বাণ মারার ক্ষমতায় অভিজ্ঞ ছিলেন। শ্রবণের নদী থেকে জল খাওয়ার শব্দকে মৃগের জল খাওয়া বলে ভুল করে তিনি শব্দভেদী বাণ মারেন। এই বাণের আঘাতে শ্রবণ কুমারের মৃত্যু হয়েছিল। পুত্রের মৃত্যুর কথা জানতে পেরে অন্ধ পিতা-মাতা চোখের জল ফেলতে থাকেন। এই ভুলের দ্বারা অনুতপ্ত দশরথ রাজা শ্রবণ কুমারের মা-বাবার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করেন। বিপরীতে তারা দশরথ রাজারও পুত্রশোকে মৃত্যু হবে বলে অভিশাপ দেন।
২.রামকে জলন্ধরের স্ত্রীর অভিশাপ
এক সময় জলন্ধর নামে একটি দুর্দান্ত রাক্ষস ছিল। শিব তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন, কিন্তু তাকে বধ করতে পারেননি। বিষ্ণু জানতেন যে জলন্ধরের স্ত্রী বৃন্দার ধর্মনিষ্ঠার কারণে জলন্ধর জয় লাভ করেছে। তখন বিষ্ণু বৃন্দার সামনে জলন্ধর রূপে যায়এবং সে তাকে স্বামী ভেবে তাকে জড়িয়ে ধরে। যখন বৃন্দা বুঝতে পারে যে তাকে ঠকানো হয়েছে , তখন সে বিষ্ণুকে অভিশাপ দেয় যে কোনও এক দিন তার নিজের স্ত্রী তার কাছ থেকে চুরি হয়ে যাবে, বৃন্দার এই অভিশাপ সত্য হয়েছিল যখন বিষ্ণু রাম রুপে জন্মগ্রহণ করেন তখন রাবণ দেবী সীতাকে হরণ করেন।
৩.সীতাকে তোতাপাখির দেওয়া অভিশাপ
শৈশবে এক অভিশাপের কারণে গর্ভাবস্থায় সীতা নির্বাসনে ছিল. [ পদ্ম-পুরাণ অনুসারে, সীতা যখন যুবতী ছিলেন তখন একজোড়া ঐশ্বরিক তোতাপাখি ধরেছিলেন যা বাল্মীকির আশ্রমে ছিল। পাখিরা শ্রী রামের কাহিনী নিয়ে কথা বলছিলেন যা সীতার মনে কৌতূহল জাগিয়ে তোলে। সীতার পশুপাখির সাথে কথা বলার ক্ষমতা ছিল। মহিলা পাখি তখন গর্ভবতী ছিল। তিনি সীতাকে তাদের ছেড়ে দিতে এবং বাল্মিকীর আশ্রমে ফেরত দিতে অনুরোধ করেছিলেন কারণ তারা কেবল শ্রী রামের বিবাহ পর্যন্ত গল্প জানেন তবে সীতা কেবল তার পুরুষ সঙ্গীকে উড়ে যেতে দিয়েছিলেন কিন্তু স্ত্রী তোতা তার সঙ্গীর থেকে পৃথক হওয়ার কারণে মারা গিয়েছিলেন। ফলস্বরূপ, পুরুষ পাখি সীতাকে অভিশাপ দিয়েছিল যে তিনি গর্ভাবস্থায় স্বামী থেকে পৃথক হওয়ার একই পরিণতি ভোগ করবেন
৪.অহল্যাকে গৌতমমুনির অভিশাপ
রামায়ণের অভিশাপ গৌতম অহলাকে অভিশাপ দিয়ে বলেছিলেন যে হাজার হাজার বছর ধরে সমস্ত প্রাণীর কাছে অদৃশ্য থাকবে, । তবুও, তিনি অহল্যাকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে,যখন রাম আশ্রমে আসবেন তখন রামের প্রতি তাঁর আতিথেয়তা বাড়ানোর পরে তার পাপ ক্ষমা হবে। এরপরে গৌতম আশ্রম ত্যাগ করে হিমালয়ে গিয়ে তপস্যাচর্চা করেন। অযোধ্যার রাজপুত্র রাম, তাঁর ভাই লক্ষ্মণ এবং তাদের গুরু, ঋষি বিশ্বামিত্র মিথিলায় রাজা জনকের দরবারে বেড়াতে যাওয়ার সময় গৌতমের নির্জন আশ্রমে গিয়েছিলেন। আশ্রমের কাছে যাওয়ার সময়, বিশ্বামিত্র অহল্যার অভিশাপের কাহিনী বর্ণনা করেন এবং রামকে অহল্যাকে বাঁচানোর নির্দেশ দেন।
বিশ্বামিত্রের অনুসরণে রাজকুমাররা অহল্যাকে দেখতে আশ্রমে প্রবেশ করেছিলেন, তিনি তখন পর্যন্ত মহাবিশ্ব থেকে লুকিয়ে ছিলেন। তাঁর গুরুর নির্দেশে রাম অহল্যাকে খাঁটি ও নির্দোষ মনে করেন এবং রাম তাঁর পায়ে স্পর্শ করে তাঁকে প্রণাম করেন, যা অহল্যাকে তার অভিশাপ থেকে মু্ক্তি দান করে। অহল্যা তাদের অভিনন্দন জানিয়ে নৈবেদ্য তৈরি করে তাদের অভ্যর্থনা করেন এবং তাদের পা ধুয়ে দেন। দেবতারা তাদের উপর পুষ্পবৃষ্টি করেন। এরপরে অহল্যা তার অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়ার পর গৌতম তাঁর আশ্রমে ফিরে এসে তাঁকে গ্রহণ করেন
৫.হনুমানকে এক ঋষির অভিশাপ
রামায়ণের অভিশাপ শৈশবকালে হনুমান দুষ্টু হওয়ার খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এইরকম একটি ঘটনার সময়, একজন ঋষি বিরক্ত হয়ে হনুমানকে বেঁধে রেখেছিলেন। এবং অভিশাপ দিয়েছিলেন যে হনুমান অন্য কোনও ব্যক্তির দ্বারা তার নিজের যোগ্যতা স্মরণ করতে সক্ষম হবেন।
রামায়নের কিশকিন্ধা কাণ্ড এবং সুন্দর কাণ্ডে অভিশাপটি উল্লেখ করা হয়েছে।
সীতাকে যখন রাবণ দ্বারা অপহরণ করা হয়েছিল, তখন জাম্ববান হনুমানকে তাঁর শক্তিগুলি স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল, যাতে তিনি সীতার সন্ধানে যেতে পারেন।
৬.রামকে তারার অভিশাপ
ভগবান রামের উপর অভিশাপ রামায়ণের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক অজানা সত্য।
রাম বালির ভাই সুগ্রীবকে রাজা হতে সহায়তা করেছিলেন।
রামায়ণের অভিশাপ রাম যখন বালিকে হত্যা করেছিলেন, তখন তাঁর স্ত্রী তারা রামকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে তিনি শীঘ্রই তাঁর স্ত্রী সীতাকে পুনরুদ্ধার করার পরে আবার হারাবেন। কাহিনীটি রামায়ণে লিপিবদ্ধ রয়েছে।
তারা আরও অতিরিক্তভাবে রামকে অভিশাপ দিয়েছিল যে রামের পরবর্তী জন্মে, রামকে বালি হত্যা করবে। ভগবান রাম পরবর্তী জন্মে শ্রী কৃষ্ণ রুপে জন্মগ্রহণ করেন এবং বালি জরা নামে একজন শিকারী রুপে শ্রীকৃষ্ণ কে তীর ছোড়েন। এবং এভাবে শ্রীকৃষ্ণ তার লিলা শেষ করেন।
রামায়ণের অভিশাপ রাজা দশরথের মৃত্যুর খবর জানার পর। রাম লক্ষণ ও সীতা তার পিন্ড দান করতে চান। কিন্তু তারা তখন বনবাসে কি দিয়া করবে সেই পিন্ড। পিন্ডদানের কিছু দ্রব্য আনতে দুই ভাই বাইরে গেলেন আর মাতা সীতাকে ফল্গু নদীর তীরে রেখে গেলেন।সীতা মাতা নদীর বালি নিয়ে খেলছিলেন।এমন সময় রাজা দশরথ মাতা সীতার কাছে পিন্ড চান। সীতা শ্রী রামের অগোচরে পিন্ড দিতে চান না।
কিন্তু দশরথ বলেন আমি ক্ষুদায় খুব কষ্ট পাচ্ছি। তুমি আমাকে বালুকা পিন্ড দান করো, কিন্তু সীতা বলেন শ্রী র্যাম আসে যদি বিশ্বাস না করে। তখন দশরথ বলেন তুমি তাহলে সাক্ষী রেখে দাও. তখন সেখানে একজন ব্রাম্মন ফল্গু নদী, তুলসী বৃক্ষ,গাভী , এবং একটা বট বৃক্ষ ছিল. সীতা এদেরকে সাক্ষী রাখেন. রাম লক্ষণ ফিরে এলেন। সীতা সবিস্তারে পুরো কাহিনী বর্ণনা করলেন। রাম লক্ষ্মণ ঘটনা অবিশ্বাস করলে তিনি 5 সাক্ষীকে ডেকে পাঠান। আশ্চর্যজনক ভাবে নদী, তুলসী, গাভী, ও ব্রাহ্মণ প্রত্যেকেই এই ঘটনা অস্বীকার করে। শুধুমাত্র অক্ষয় বট সত্যি কথা বলে। এই ঘটনার পর ওই চার সাক্ষীকে অভিশাপ দেন সীতা। তিনি বলেন ফল্গু নদী গয়ায় কেবলমাত্র মাটির নীচ দিয়ে বইবে। গরুকে অভিশাপ দিলেন যে গো কূলের মুখ অপবিত্র বিবেচিত হবে। পবিত্র বিবেচিত হবে শুধুমাত্র তাদের পেছনের অংশ। এরপর অভিশপ্ত হল তুলসী। সীতা বললেন এরপর থেকে গয়ায় কোনো তুলসী গাছ থাকবে না। আর কুকুর তুলসী মনচে মূএ ত্যাগ করবে।ব্রাহ্মণকে অভিশপ্ত করল যে তারা কখনোই পরিতৃপ্ত হবেন না। সবসময় ক্ষুধার্থ থাকবে ও আরো বেশী চাহিদা তৈরি হবে তাদের মধ্যে।
৮.রাবনকে আনারণ্যের অভিশাপ
রামায়ণের অভিশাপ রাবণ যখন বিশ্ব জয়ের পথে পা রেখেছিলেন, তখন তিনি অনারন্যের সাথে দেখা করলেন। আনারন্য ছিলেন রঘুবংশের একজন পরম মহিমান্বিত রাজা । দু’জনের দেখা হয়ে গেলে তুমুল লড়াই হয়। যদিও উভয়ের মধ্যে নেতৃত্বাধীন যুদ্ধে রাজা আনারন্য প্রাণ হারান। কিন্তু মৃত্যুর সময় শেষ নিঃশ্বাস নেওয়ার আগে তিনি রাবণকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে, আমার বংশে জন্মগ্রহণকারী এক ব্যক্তির দ্বারা রাবণ প্রান হারাবে। পরে, ভগবান রাম অনারনয়েরর বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং রাম রাবণকে হত্যা করেছিলেন।
৯.রাবণকে নন্দীর অভিশাপ
একবার রাবণ শিবের সাথে দেখা করতে কৈলাশ পর্বতে গিয়েছিলেন। কৈলাশে তিনি নন্দী-ষাঁড় সম্পর্কে উপহাস করেছিলেন। নন্দী হলেন ষাঁড় এবং সে মহাদেবের সঙ্গে থাকেন । নন্দীকে উপহাস করায় নন্দী রাগে রাবণকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে বানররা রাবণের মৃত্যুর কারণ হবে। নন্দীর অভিশাপ সত্য হয়েছিল, যখন বানর সেনা রাবনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ভগবান রামকে সহায়তা করেছিল।
১০.রাম কে দেবর্ষি নারদ এর অভিশাপ
রাজা দশরথের ঔরসে কৌশল্যার গর্ভে জন্ম নেন রাম।
রামায়ণের অভিশাপ এক সময় নারায়ণের ওপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন দেবর্ষি নারদ। একদিন এক সুন্দরী রাজকন্যার প্রেমে পড়েন নারদ। সেই রাজকন্যার তখন স্বয়ম্বরের আয়োজন চলছিল। নারদ সুদর্শন না হওয়ায় বিষ্ণুর কাছে আবেদন জানান যাতে স্বয়ম্বরের সময় বিষ্ণু নিজের রূপ নারদকে দান করেন। বিষ্ণুর আশির্বাদ পেয়ে স্বয়ম্বর সভায় যান দেবর্ষি কিন্তু রাজকন্যা বরমাল্য হাতে তাঁর সামনে এসে হো হো করে হেসে ওঠেন। আসলে নারদের মুখের জায়গায় একটা বানরের মুখ বসিয়ে দিয়েছিলেন নারায়ণ।
বিষ্ণুর এই ঠাট্টায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে নারদ তাঁকে অভিশাপ দেন যেভাবে নিজের প্রেমকে কাছে না পেয়ে তিনি ব্যাথিত হয়েছেন, সেরকমই একদিন নিজের স্ত্রীকে হারিয়ে দুঃখে কাতর হতে হবে বিষ্ণুকে। রাম-রূপে জন্মগ্রহণ করে সীতার সঙ্গে চির বিচ্ছেদের বিরহ ভোগ করেছেন নারায়ণ।