১৪৭৩ খ্রিষ্টাদ্বে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায় একচক্রা গ্রামে প্রভু নিত্যানন্দ জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর পিতার নাম হাড়াই পন্ডিত এবং মাতার নাম পদ্নাবতী।হাড়াই পন্ডিত ছিলেন একজন সৎ ব্রাক্ষণ।পৈতৃক বিষয়-সম্পওি এবং যজন-যাজনের কাজ মিলিয়ে তাঁর সংসারটি ছিল বেশ স্বচ্ছল।
নিত্যানন্দের প্রকৃত নাম ছিল কুবের।গ্রামের পাঠশালায় পিতা তাঁর বাল্যশিক্ষার ব্যবস্থা করেন।ছাএ হিসেবে মেধাবী ছিলেন।কিন্তু পড়াশোনায় তাঁর একদম মন ছিল না।তাঁর চেয়ে ধর্মের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল বেশি।ধমকথা শুনতে তিনি খুব ভালোবাসতেন।
পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে তিনি খেলাধুলা করতেন।
খেলার পরিবর্তে গিয়ে বসে থাকতে তবে তাঁর বেশি ভালো লাগত কোনো মন্দিরে।ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর এই ধর্মানুরাগের মূলে ছিলেন।শুধু শ্রীকৃষ্ণের কথাই ভাবতেন কুবের।এই ছিল তাঁর সারাক্ষণের ভাবনা কীভাবে তাঁকে পাওয়া যায়।তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করতেন কোনো সাধু সন্ন্যাসীকে দেখলেই কী করলে শ্রীকৃষ্ণকে পাওয়া যাবে।
কুবেরের বয়স তখন বারো বছর।তখন এক সন্ন্যাসী তাঁদের গাঁয়ে এলে।তাঁদেরই বাড়ি উঠলেন।তিনি যাবেন বৃন্দাবনের।বৃন্দাবন শ্রীকৃষ্ণের লীলাক্ষেএ কুবের শুনেছেন।তাই তিনি ভাবলেন, বৃন্দাবন গেলে হয়তো তাঁর প্রাণের ঠাকুর কৃষ্ণকে পাওয়া যাবে।কুবের সন্ন্যাসীকে তাঁর মনের কথা বললেন।সন্ন্যাসী বললেন, এত অল্প বয়সে সন্ন্যাস নেয়া ঠিক নয়।তাছাড়া সন্ন্যাস নিতে হলে পিতা-মাতার সম্মতি রাগে।কিন্তু কুবের নাছোড়বান্দা।তিনি বৃন্দাবনে যাবেনই।
অগত্যা পিত-মাতার সম্মতি নিয়ে তিনি গৃহত্যাগ করলেন সন্ন্যাসীর সঙ্গে।অনেক পাহাড়-পবত,অরণ্য, র্তীথস্থান ঘুরে বেড়াতে লাগলেন।বছরের পর বছর কেটে গেল। একদিন কুবের সন্ন্যাসীকে হারিয়ে ফেললেন হঠাৎ।তারপর তিনি একাই বিভিন্ন র্তীথ পযটন করতে লাগলেন।
একদিন উপস্থিত হলেন কাক্ষিত বৃন্দাবনে তাঁর।
এখানে এসে ব্যাকুল হয়ে উঠল তাঁর মন।
শ্রীকৃষ্ণের স্থানসমূহ স্মৃতিবিজড়িত ঘুরে বেড়াতে লাগলেন তিনি পাগলের ন্যায়।
একদিন তাঁর সাক্ষাৎ হয় পরম সন্ন্যাসী শ্রীপাদ মাধবেন্দ্রপুরীর সঙ্গে।তাঁর কাছে তিনি কৃষ্ণমক্রে দীক্ষা নেন।গুরু সঙ্গে কিছুদিন বৃন্দাবনে থেকে কুবের আবার বেরিয়ে পড়লেন র্তীথ পযটনে।একা একা বেশ কিছুদিন ঘুরে বেড়ান।এ সময় তিনি রামেশ্বর, নীলাচল, গঙ্গাসাগর প্রভৃতি র্তীথস্থান ভ্রমণ করেন।কিন্তু ব্যাকুলতা তাঁর ক্রমেই বাড়তে থাকে কৃষ্ণবিরহের। কৃষ্ণদশন কীভাবে হবে তাঁর একটাই চিন্তা।তাই আবার বৃন্দাবনে ফিরে গেলেন তিনি।
কুবের সবদা বিভোর থাকেন কৃষ্ণচিন্তায়।কীভাবে কখন কৃষ্ণদশন হবে-এই তাঁর একমাএ ভাবনা। তাঁর দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছিল এই ভাবনায়।হঠাৎ একদিন তিনি স্বপ্নে দেখেন কৃষ্ণকে।কৃষ্ণ তাঁকে বলেছেন, তুমি গৌড় দেশে নবদ্বীপে যাও।সেখানে নিমাই পন্ডিত আচন্ডালে প্রেমভক্তি প্রচার করেছেন।তাঁর সঙ্গে যোগ দাও।উল্লেখ্য যে, এই নিমাই পন্ডিতই শ্রীগৌড়াঙ্গ বা শ্রীচৈতন্য নামে পরিচিত।কুবেরের স্বপ্নে কৃষ্ণদশন হওয়ার মন অনেকটা শান্ত হয়।তিনি শ্রীকৃষ্ণের দশন লাভ করেছেন স্বপ্নে।তিনি বৃন্দাবন তাঁর আদেশে ছেড়ে নবদ্বীপে নন্দন আচার্যের গৃহে নিমাইয়ের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়।বুঝতে পারেন,দুজন দুজনকে চিনতে পারেন।দুয়ে মিলে যেন এক তাঁরা।যেন দুই দেহে তাঁদের আবির্ভাব ঘটেছে জীবোদ্বারের জন্য।সেদিন থেকে কুবেরের নতুন নাম হলো নিত্যানন্দ।সংক্ষেপে নিতাই।আর গৌড়াঙ্গের সংক্ষিপ্ত নাম গৌর।ভক্তরা সংক্ষেপে বলতেন গৌর-নিতাই।
গৌর-নিতাই দুজনে নবদ্বীপে প্রেমভক্তি প্রচার করতে লাগলেন।নেচে-গেয়ে তাঁরা হরিনাম বিলাতে লাগলেন।তাঁদের প্রেমধর্মে কোনো জাতিভেদ নেই।উঁচু-নীঁচু নেই।তখন সমাজে শুল্ক ধর্মাচরণ প্রবল হয়ে উঠেছিল।মানবপ্রেম তার নীচে চাপা পড়েছিল।তাই প্রেমভক্তি দিয়ে গৌর-নিতাই সমাজের সবাইকে কাছে টেনে নিলেন।ফলে দলে-দলে লোক তাঁদের অনাসারী হলো।
কিন্তু বৈষ্ণববিদ্বেষীরা গৌর-নিতাইয়ের এই প্রেমধম প্রচারে বাধা দিতে লাগলেন।কখনো কখনো তাঁদের ওপর আক্রমণ চালান।
তখন নবদ্বীপে জগন্নাথ ও মাধব নামে দুই ভাই নগর কোতোয়ালের কাজ করতেন।লোকে তাঁদের বলত জগাই-মাধাই।তাঁরা ছিলেন মদ্যপ এবং ভয়ঙ্কর প্রকৃতির।যখন যা খুশি তা-ই করতেন।কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস করত না।নিত্যানন্দ এ-কথা জানতে পারলেন।তিনি শ্রীগৌরাঙ্গের বললেন, জগাই-মাধাইকে উদার করতে হবে।প্রভু মৌন সম্মতি দিলেন।
তাঁরপর একদিন নিত্যানন্দ ও হরিদাস কৃষ্ণনাম করতে করতে পথ দিয়ে ফিরছেন।হঠাৎ জগাই-মাধাইয়ের সঙ্গে তাঁদের দেখা।মদ খেয়ে তখন তাঁরা মাতাল।কৃষ্ণনাম শুনে তাঁরা ক্রোধে ফেটে পড়ছেন।
একটা ভাঙ্গা কলসির কানা ছুঁড়ে মারলেন নিতাইয়ের দিকে মাধাই।মাথায় লেগে কেটে গেল।রক্ত পড়তে লাগল দরদর করে।কিন্তু নিত্যানন্দ এক হাতে ক্ষতস্থান চেপে ধরে কৃষ্ণনাম গেয়েই চললেন।এতে মাধাই আরো ক্ষেপে গিয়ে আবার নিতাইকে মারতে গেলেন।
কিন্তু জগাই তাঁকে আটকালেন।কয়েকজন পথচারী ইতিমধ্যে সেখানে জড় হয়েছেন।তাঁদের মায়া হলো নিতাইয়ের অবস্থা দেখে।কিন্তু জগাই-মাধাইয়ের ভয়ে কেউ কোনো কথা বলল না।
ঘটনাটি শ্রীগৈারাঙ্গের কানেও গেল।সঙ্গে সঙ্গে তিনি দল-বল নিয়ে ছুটে আসেন ঘটনাস্থলে।তাঁর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেছে।জগাই-মাধাইকে তিনি কঠোর দন্ড দেবেন।নিত্যানন্দ তখন এগিয়ে এসে বললেন, প্রভু জগাইয়ের কোনো দোষ নেই।সে আমাকে রক্ষা করেছে।মাধাইও ভুল করে এ-কাজ করেছে।তুমি এদের ক্ষমা করে দাও।নিত্যানন্দের কথা শুনে গৈারাঙ্গ অনেকটা শান্ত হলেন।তিনি এগিয়ে জগাইকে বুকে টেনে নিলেন।তা দেখে মাধাইয়ের মনে অনুশোচনা এল।তিনি এগিয়ে এসে বললেন, প্রভু আমি অপরাধ করেছি।আমায় ক্ষমা করে দাও।
গৈারাঙ্গ বললেন, নিতাই যদি তোমায় ক্ষমা করে তাহলে তুমি ক্ষমা পাবে।এরপর মাধাই জোরহাতে এগিয়ে গেলেন নিত্যানন্দের দিকে।নিত্যানন্দ তাকে বুকে টেনে নিলেন।এভাবে গৌড়-নিতাই তাঁদের প্রেমভক্তি দিয়ে জগাই-মাধাইকে উদ্বার করলেন।উপস্থিত লোকজন সবাই ধন্য-ধন্য করতে লাগল।এভাবে গৌড়-নিতা নবদ্বীপে কৃষ্ণনাম র্কীতন ও প্রেমভক্তি দিয়ে আপন করে নিতে লাগলেন সবাইকে।ভেদাভেদ কমতে লাগলমানুষে-মানুষে।
এমন সময় একদিন শ্রীগৈারাঙ্গ সন্ন্যাস নিয়ে নীলাচলে গেলেন।নিত্যানন্দও সঙ্গে গেলেন।সেখানে কিছুদিন থাকার পর গৌরাঙ্গ একদিন বললেন, নিত্যানন্দ গৌড়ে এখন একদিকে চলছে শক্তি বা তএসাধনা, অন্যদিকে চলছে নব্যন্যায়ের যুক্তিসবস্ব জ্ঞানতও্বচর্চা।ধমপিপাসু সাধারণ মানুষ কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছেনা।তুমি সেখানে গিয়ে সংসারী হও এবং বিদ্বান, মূখ, ব্রাক্ষণ, চন্ডাল, ধনী, দরিদ্র সকলের মধ্যে হরিনাম ও প্রেমধম বিতরণ কর।সকলকে এক কৃষ্ণনামে আবদ্ব কর।
একথা শুনে নিত্যানন্দের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হলো।তাকে প্রভুর সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে।কিন্তু প্রভুর আদেশ মানতে হবে।তাই নিত্যানন্দ গৌড়ে ফিরে এলেন এবং কালনার অধিবাসী সূযদাসের দুই কন্যা বসুধা ও জাহুবীকে বিবাহ করেন।তাঁদের নিয়ে তিনি খড়দেহে সংসার পাতেন।বসুধার পুএ বীরভদ্র। জাহুবীর কোনো সন্তান না থাকায় তিনি এক পোষ্যপুএ গ্রহণ করেন।তাঁর নাম রাসাই গোস্বামী ।খড়দেহের গোস্বামীরা এদেঁরই বংশধর ।নিত্যানন্দ ধারার গোস্বামীরা গৌড়দেশে সমাজজীবন বেশ কিছুকাল ধরে প্রেমধর্মের প্রসার ঘটান।
গৌরাঙ্গের দ্বারা আদিষ্ট হয়ে নিত্যানন্দ গৌড়রাজ্য, বিশেষত নবদ্বীপে কৃষ্ণনাম ও প্রেমধম প্রচার করতে লাগলেন।
কৃষ্ণনামের পাশাপাশি তিনি র্কীতন করতেন
ভজ গৌরাঙ্গ কহ গৌরাঙ্গ লহ গৌরাঙ্গের নাম।
ভজ গৌরাঙ্গ কহ গৌরাঙ্গ লহ গৌরাঙ্গের নাম।
এভাবে তিনি কৃষ্ণনামের সঙ্গে একীভূত করে দেন শ্রীগৌরাঙ্গের নাম।গৌরাঙ্গ-প্রবতিত প্রেমধর্মের এক মহাপ্রচারকরূপে গৌড়দেশে আর্বিভূত হন নিত্যানন্দ।ধমতও্বের কোনো বিচার-বিশ্লেষণ বা তক-বিতক নেই, আচার-অনুষ্ঠানের কোনো বাড়াবাড়ি নেই, শুধু আচন্ডালে প্রেম বিতরণ আর কৃষ্ণনামগান।এভাবে প্রেমভক্তি আর কৃষ্ণনাম প্রচারের মাধ্যমে তিনি অনেক পাপী-তাপীকে উদ্বার করেছেন।সকলকে কৃষ্ণভক্তরূপে ভালোবেসেছেন।তাঁর এই জীবোদ্বারে কথা সারা গৌড়ে ছড়িয়ে পড়ে।দলে-দলে লোকজন তাঁর কাছে ছুটে আসতে থাকে।এর ফলে হিন্দু ধম ও সমাজ জীবনে এক বিরাট আন্দোলনের সৃষ্টি হন।সকলে সমস্ত রকম ভেদাভেদ ভুলে এক সারিতে এসে দাঁড়ায়।র্সাথক হয় শ্রীগৌরাঙ্গের প্রেমভক্তি ও কৃষ্ণনামের আন্দোলন।নিত্যানন্দও চির অমর হয়ে থাকেন গৌড়বাসীর অন্তরে।
১৫৪২ খ্রিষ্টাদ্বে এই মহাসাধক ইহলীলা সংবরণ করেন।