শ্রীমা

১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দের ২১ এ ফেব্রুয়ারি ফ্রান্সের প্যারিস শহরে শ্রীমা জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর প্রকৃত নাম শ্রীমা।ভারতের পণ্ডিচেরীতে অরবিন্দু আশ্রমে এসে তাঁর নাম হয় শ্রামা।ভারতবাসীর কাছে তিনি এই নামেই পরিচিত।

শৈশবকাল থেকেই শ্রীমার মধ্যে আধ্যাত্নিক ভাব জেগে ওঠে।তাঁর বয়স যখন মাএ চার, তখনই পড়াশোনার ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়তেন।আর পাঁচজন শিশু মতো শৈশবেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।কিন্তু পড়াশোনার প্রতি তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না।এতে তাঁর বাবা-মা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন।শুধু পড়াশোনা নয়, পার্থিক কোনো কিছুই প্রতিই শ্রীমার কোনো আসক্তি ছিল না।আধ্যাত্নিক চিন্তা-ভাবনায় মগ্ন থাকতেন।

প্যারিস শহরের বাইরে ছিল এক প্রকান্ড বন।শ্রামী সময় পেলেই সেখানে গিয়ে গাছতলায় ধ্যানে বসতেন।তখন পাখিরা র্নিভয়ে এসে তাঁর শরীরে বসত।কাঠবিড়ালীরা ছুটোছুটি করত তাঁর ওপর দিয়ে।এমনিভাবে বনের গাছপালা ও পশুপাখির সঙ্গে তাঁর এক আত্নিক সম্পক গঠে ওঠে।

মায়ের বয়স যখন উনিশ বছর, তখন তিনি আলজিরিয়ার ক্লেমসেন শহরে যান।সেখানে তেঁও নামে এক বিখ্যাত গুণীন থাকতেন।তাঁর কাছ থেকে তিনি হঠযোগ ও অনেক গুরুবিদ্যা অজন করেন।

দেশে ফিরে শ্রীমা গভীর সাধনায় মগ্ন হন।তিনি উপলদ্ধি করেন, ঈশ্বর আছেন।তাঁর সঙ্গে মানুষের আত্নিক মিলন সম্ভব।ঈশ্বরকে তিনি সব সময় জ্যোতিময়রূপে দেখতে চান।একবার তিনি এক জ্যোতিময় পুরুষকে স্বপ্নে দেখেন।তিনি যেন তাঁকে বলছেন; ওঠ, আরো ওপরে ওঠ।সকলকে ছাড়িয়ে ওপরে ওঠ, কিন্তু সকলের মধ্যে ব্যাপ্ত করে দাও নিজের আত্নাকে।

শ্রীমা এবার ভারতীয় দশন ও ধমতও্ব পড়তে শুরু করেন।তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে, নিরাকার নির্গুণ ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণের মধ্যেই রূপ পরিগ্রহ করে আর্বিভূত হয়েছিলেন।তাই শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব স্থান ভারতবর্ষে আসার জন্য তাঁর মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে।১৯১৪ খ্রিষ্টাদ্বে তিনি স্বামী মঁসিয়ে পল রিশারকে নিয়ে চলে আসেন ভারতবর্ষে।ঘুরতে ঘুরতে তাঁরা ২৯ শে র্মাচ পন্ডিচেরীর অরবিন্দু আশ্রমে উপস্থিত হন।সেখানে ঋষি অরবিন্দুকে দেখে শ্রীমার স্বপ্নে দেখা সেই জ্যোতিময় পুরুষের কথা মনে পড়ে গেল।তাঁর মনে হলো, তিনি যেন বিধিনির্দিষ্ট এক বিশেষ দিব্যকম করার জন্য এই পৃথিবীতে এসেছেন এবং মহাযোগী শ্রীঅরবিন্দের সহযোগিতা ছাড়া তা সম্ভব নয়।তিনি উপলদ্ধি করলেন, অরবিন্দের সঙ্গে মিলিত হওয়ার মধ্যেই আছে তাঁর আত্নার মুক্তি।সারা পৃথিবীর মধ্যে চন্ডিচেরীর আশ্রমেই তাঁর কাছে স্বগ মনে হলো।এই শান্ত তপোবনের মধ্যে তিনি খুঁজে পেলেন তাঁর সকল সাধনার সিন্ধি, তাঁর আত্নার চূড়ান্ত র্সাথকতা।তাই তাঁরা দুজনেই আশ্রমে থেকে গেলেন।শ্রীঅরবিন্দের নিকট দীক্ষা নিলেন।তাঁর সাধক কর্মের সহযোগী হয়ে উঠলেন।তখন আশ্রম থেকে ইংরেজ ও ফরাসি ভাষার আয নামে একটি পএীকা প্রকাশিত হতো।তাঁরা দুজনেই এক পএীকা প্রকাশের ব্যাপারে অরবিন্দকে সাহায্য করতে লাগলেন।

কিস্তু এ যাএায় শ্রীমা বেশিদিন ভারত পারেন নি।প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই তাঁদের প্যারিসে ফিরে যেতে হলো।এতে মা-র মন খুব আকুল হয়ে ওঠে।শ্রীঅরবিন্দের সঙ্গে বিচ্ছেদ তাঁর কাছে পরমাত্না  ও জীবাত্নার বিচ্ছেদের মতো মনে হতে লাগল।তিনি আকুল নয়নে র্পূব দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

এভাবে কেটে গেল প্রায় পাঁচ বছর।ইতিমধ্যে যুদ্ধ থেকে গেল।হঠাৎ অরবিন্দের কাছ থেকে তিনি আহবান পেলেন ভারতবর্ষে আসার।তাঁর মন উদ্ধেল হয়ে উঠল।আর বিলম্ব নয়।তিনি যাএা করলেন ভারতবর্ষের উদ্দেশ্যে।১৯২০ খ্রিষ্টাদ্বে ২৪ এ এপ্রিল তিনি পন্ডিচেরীতে পৌছান।তাঁর মন শান্ত হলো।এবার গুরুদেবের নির্দেশ মতো তিনি নিয়মিত যোগ সাধনা শুরু করে দিলেন।ইউরোপীয় বেশভূয়া ত্যাগ করে ভারতীয় যোগিনীর বেশ ধারণ করলেন।তাঁর পরনে তখন দেশী শাড়ি ও ব্লাউজ।খাদ্যদ্রব্যও দেশীয়।আমিষের পরিবর্তে নিরামিষ।পরে অবশ্য শ্রীঅরবিন্দের নির্দেশ মা ইউরোপীয় পোশাকও পরতেন।কারণ অরবিন্দ বলতেন, ইন্দ্রিয় ও মনকে জয় করতে পারলে বাইরের পোশাক-পরিচ্ছদে কিছু যায় আসে না।

১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ এ নভেম্বর শ্রীঅরবিন্দ র্পূণ সিন্ধি লাভ করেন।সেদিন থেকেই একটি ঘরে তিনি নিজেকে আবদ্ব করে রাখেন।ফলে আশ্রমের সমস্ত ভার পড়ে শ্রীমার ওপর।শ্রীমাও সর্বান্তঃকরণে সে ভার গ্রহণ করেন।তিনি পৈতৃক সূএ অনেক সম্পদ ও অথ পেয়েছিলেন।তা দিয়ে তিনি আশ্রমের খরচ চালাতে লাগলেন।দিনদিন আশ্রমে লোকজন বাড়তে লাগল।শ্রীমাও অতিশয় যোগ্যতার সঙ্গে সকলের ভরণ-পোষণ করে যেতে লাগলেন।কমফলের প্রতি সমস্ত আসক্তি ত্যাগ করে তিনি পরের মঙ্গলের জন্য কাজ করে যেতে লাগলেন।খাদ্য, কৃষি, শিল্প, গো-পালন প্রভৃতি বিভাগ খুলে শ্রীমা আশ্রমটিকে একটি স্বয়ংসর্ম্পূণ প্রতিষ্ঠানরূপে গড়ে তুললেন।

শ্রীমা বুঝতে পেরেছিলেন যে, আধ্যাত্নিক সাধনা করতে হলে শরীরকে সুস্থ রাখতে হয়।এজন্য যোগব্যামায় প্রয়োজন।তাই আশ্রম তিনি একটি ব্যায়ামগার গড়ে তোলেন।

শ্রীঅরবিন্দের পরিকল্পনা অনুযায়ী শ্রীমা আশ্রমে একটি ছোট্ট পাঠশালা খোলেন।সেখানে ছেলে-মেয়েরা মনের আনন্দে লেখাপড়া করত।ক্রমে পাঠশালা থেকে বিদ্যালয় ও পরে তা বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয়।তাঁর নাম হয় আন্তর্জাতিক শিল্পকেন্দ্র।এখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় শিক্ষা দেয়া হয়।তবে সবাইকে আধ্যাত্নিক ভাবে সমৃদ্ধ করে তোলা হয়।শ্রীমা এখানে ধম ও কলাবিদ্যার এক র্সাথক সমন্বয় সাধন করেছিলেন।এখানে বিশ্বের যে-কোনো শিক্ষার্থী পড়াশোনা করতে পারে।

আশ্রমবাসীদের চিকিৎসার জন্য একটি হাসপাতাল স্থাপন করেন।এ হাসপাতালে সকলকে বিনামূলে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়।

আশ্রমে যাঁরা থাকেন, তাঁদের থাকা-খাওয়ার সমস্ত ব্যায়ভার আশ্রমই বহন করেন।আশ্রমের নিজস্ব জমি, বাগান ও দুগ্ধ খামার আছে।সেসব থেকে চাল, ফলমূল, দুধ ইত্যাদি পাওয়া যায়।।অর্থাৎ শ্রীমা সত্যিকারের অর্থেই আশ্রমটিকে একটি স্বয়ংসর্ম্পূণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিলেন।

আশ্রমের একটি বিশেষ শিক্ষণীয় বিষয় হলো সমস্তরকম ভেদজ্ঞানের বিলোপ।আশ্রমে যাঁরা থাকেন তাঁদের সকলকেই কাজ করতে হয়।ছোট-বড় কাজে কোনো র্পাথক্য নেই।যে-কেউ-যে-কোনো কাজ করেন।ধর্মীয় গোঁড়ামি বলতে কিছু নেই।মা চাইতেন আশ্রমবাসীরা ধমতও্ব সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে সকল ধম সম্পর্কে উদার ও শ্রদ্ধাশীল হোক।বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাএ-ছাএীরা এই শিক্ষা নিয়ে আশ্রমের আদশ সবএ ছড়িয়ে দিক।

আশ্রমের সকলকে মা সন্তানের ন্যায় ভালোবাসতেন।নিজের মায়ের মতোই তিনি সকলের সুখ-সুবিধার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতেন।শুধু তা-ই নয়, আশ্রমের বৃক্ষ-লতা ও পশু পাখির প্রতিও মায়ের গভীর ভালোবাসা ছিল।আশ্রমে নতুন অতিথি এলে মা তাঁদের বুঝিয়ে দিতেন,কেউ যেন এদের প্রতি অসম্মান না করেন।কেউ যেন গাছের পাতা বা ফুল না ছেঁড়েন।অকারণে গাছের ডাল না ভাঙ্গেন।

মা সব সময় কাজ নিয়ে থাকতে ভালোবাসেন।দিনরাত শুধু কাজ আর কাজ।কাজই যেন ছিল তাঁর জীবন।আজীবন তিনি কামনাহীন কমযজ্ঞ করে গেছেন।

মা শুধু একজন জ্ঞানতপম্বিনী বা রুক্ষ যোগীনীই ছিলেন নাতাঁর মধ্যে প্রচন্ড সৌন্দযবোধও ছিল।এক নিবিড় সৌন্দযবোধের দ্বারা তিনি বহিঃপ্রকৃতি ও অন্তঃপ্রকৃতি মধ্যে চমৎকার সামঞ্জস্য সাধন করে চলতেন।তিনি চাইতেন মানুষের  অন্তঃপ্রকৃতিও এমনি বাইরের প্রকৃতি মতো সুন্দর হয়ে উঠুক।এভাবে তিনি আশ্রমটিকে প্রাকৃতিক সৌন্দযের এক লীলাভূমিরূপে গড়ে তুলেছিলেন।

মানুষের এক অভাবনীয় পরিকল্পনা ছিল শ্রীঅরবিন্দের নামে অরোভিল নগর প্রতিষ্ঠা।১৯৫৪ খ্রিষ্টাদ্বে তিনি এ পরিকল্পনা করেছিলেন।এর জন্য পন্ডিচেরীর উওর-র্পুব দিকে প্রায় ছয় মাইল দূরে সমুদ্র উপকূলে ১৫ বগমাইল ভূমি সংগ্রহ করা হয়।১৯৬৮ খ্রিষ্টাদ্বের ২৮ এ ফেব্রুয়ারি এর ভিওিস্থাপন করা হয়।ভিওিমূলে পৃথিবীর ১২৬ টি দেশের মাটি এনে জড় করা হয়।ঐসব দেশের তরুণ-তরুণীরা এ মাটি নিয়ে আসেন।১৯৭২ খ্রিষ্টাদ্বের ২১ শে ফেব্রুয়ারি মায়ের শুভ জন্মদিনে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়।

মায়ের পরিকল্পনা ছিল, অরোভিল হবে একটি আধুনিক নগর।এখানে প্রায় পঞ্চাশ হাজার লোক বাস করবে।সবাই হবে এক পরিবারের সদস্য।এখানে আধুনিক নগরের সমস্ত সুযোগ-সুবিধা থাকবে।আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা, দশন, আধ্যাত্নিক সাধনা সব কিছুই চর্চা হবে এখানে।অরোভিল হবে সমগ্র বিশ্বমানবের।আন্তর্জাতিক মানব-ঐক্যের জীবন্ত ল্যাবরেটরি।এটি হবে একটি আত্নর্নিভরশীল জনপদ।এখানকার সকলেই হবে এর জীবনযাএা ও উন্নতির অংশীদার।তারাই নানাভাবে এর সকল কাজ করবে।কেউকে খাজনা দিতে হবে না।কাউকে খাবার ভাবনা ভাবতে হবে না।সকলকে খাওয়ার দায়িত্ব এই প্রতিষ্ঠানই গ্রহন করবে।সকল দেশের আচার-ব্যবহার ও খাদ্যরীতি সর্ম্পূণই বজায় রাখা হবে।।অরোভিল হবে সকল প্রকার সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাসের উর্ধ্বে উঠে একমাএ সত্যের সেবা।

মায়ের এই পরিকল্পনা অনুযায়ী অরোভিল নগর সিত্যিই গড়ে উঠেছে।২০০৬ খ্রিষ্টাদ্বে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে।সেখানকার অধিবাসীরা মায়ের আদশকে শিরোধায করে সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করেছেন।

শ্রীমা সুন্দর ছবি আঁকতে পারতেন।গানও জানতেন।ভালো অর্গান বাজাতে পারতেন।প্রতি বছরের শেষ দিন রাত বারোটাই পর তিনি অর্গান বাজিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতেন।বিভিন্ন রচনায় তাঁর সাহিত্য-প্রতিভা ও কবিত্বশক্তিরও পরিচয় পাওয়া যায়।

মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রম পন্ডিচেরীর অরবিন্দু আশ্রম সারা ভারতে এক স্থান আদশ হিসেবে খ্যাতি লাভ করে।এর আদর্শে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে অরবিন্দ আশ্রম গড়ে ওঠে।বাংলাদেশেরও অরবিন্দ আশ্রম রয়েছে।এই আশ্রমের আদশ ভারতবাসীদের জীবনে এক গভীর প্রভাব ফেলেছে।

১৯৭৩ খ্রিষ্টাদ্বের ১৭ ই নভেম্বর পন্ডিচেরীর অরবিন্দ আশ্রমে এই মহীয়সী নারীর জীবনাবসান ঘটে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *